Header Ads

মার্থাস ভাইন ইয়ার্ডে একদিন

ওক ব্লাফ বন্দর
 অ্যাকুইনা কালচারেল সেন্টার
নিউ জার্সির সমরসেট থেকে আশীষ কুমার দে  
গত ২৯ সেপ্টেম্বর হোটেল ম্যারিয়ট স্প্রিংডেল, ওয়ারউইক, রড আইল্যান্ড থেকে রওয়ানা হলাম হায়ানিস, ওশেন স্ট্রিট। এখান থেকে আমরা যাব মার্থাস ভাইন ইয়ার্ড। একঘন্টার ড্রাইভে পৌঁছে গেলাম ওশেন স্ট্রিট, এটি একটি সুন্দর ও আধুনিক বন্দর। আশেপাশে হোটেল, রিসোর্ট ও রেস্তোঁরার ছড়াছড়ি। লট নাম্বার সহ বিস্তৃত পার্কিং যা জাহাজের অগ্রিম টিকিট বুকিং এর সঙ্গেই নিতে হয়। সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ গাড়ি রাখতে গিয়ে দেখি হাজার তিনেক গাড়ি পার্ক করা, সিকিউরিটি অফিসার কে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম শীতের চার মাস বাদ দিলে প্রতিদিনই এধরনের পর্যটকদের ভিড় থাকে। এই বন্দর থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের দুটি দ্বীপে জাহাজ যাতায়াত করে। একটি মার্থাস ভাইন ইয়ার্ড ও অন্যটি নানটুকেট। আমাদের ‘Hy line cruise’ ১১টা ৪৫ মিনিটে ছাড়বে, জাহাজের কর্মীরা আমাদের নির্দিষ্ট জায়গায় লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। মালপত্র তোলা হলো চাকা লাগানো আলমারির ভেতর এর মধ্যে গল্ফ খেলার সরঞ্জাম, মাছ ধরার আধুনিক ছিপ, সাইকেল ও আছে। পর্যটকদের মধ্যে বয়স্কদের সংখ্যা বেশী তাদের সঙ্গী প্রিয় সারমেয়। জাহাজ জেটিতে লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের লাইন করে ওঠা শুরু হল, জাহাজটি দ্বিতল। যাত্রীরা কোন তলায় বসবেন নিজেদের পছন্দ মতো যাচ্ছেন। আমরা নিচেই বসলাম, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আরামদায়ক বসার জায়গা। যখন জাহাজে উঠছিলাম তখন মনে পড়ছিল আমাদের দেশের ডক গুলোর করুন অবস্থা, রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে প্রাণ হাতে যাতায়াত করতে হয়। আটলান্টিক মহাসাগরে আমরা প্রায় এক ঘন্টার মতো জাহাজে থাকব তারপর পৌঁছব গন্তব্য স্থানে। জাহাজ ছাড়ার সাথে সাথে শুরু হয় আমেরিকান পর্যটকদের পানীয় ও খাওয়ার কেনার ধুম, প্রায় প্রতিটি পর্যটক লাইনে দাঁড়িয়ে কিছু না কিছু কিনছেন, এর মধ্যে হাল্কা পানীয়, বিয়ার, ওয়াইন, কোক , ঠান্ডা কফি বেশী বিক্রি হচ্ছে। চারশো যাত্রী বহন ক্ষমতার এই ক্রুজে মাত্র দুটি ভারতীয় পরিবার। সাধারণত ছুটির দিনে পর্যটন স্থানে ভারতীয়দের ভীড় চোখে পড়ে। একঘন্টার পরে আমরা নামলাম মার্থাস ভাইন ইয়ার্ডের বন্দর "ওক ব্লাফ"। ডকের সামনে গাড়ি, স্কুটার ও সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়, অনেকেই নিজের পছন্দ মতো বাহন ভাড়া করে বেড়িয়ে পরছেন দ্বীপ দেখতে, তবে সাইকেল প্রেমীদের সংখ্যাই বেশি। ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের একটি ছোট্ট দ্বীপ মার্থাস ভাইন ইয়ার্ড, ১৬০২ সালে Bartholomow Gosnold নামের এক ইংরেজ পর্যটক সমুদ্রে অবস্থিত এই দ্বীপে নোঙ্গর করেছিলেন। এই দ্বীপটি মূলত Wampanoag নামের আদিবাসীদের বাসস্থান ছিল। পরবর্তীতে এদের জনসংখ্যা লোপ পায় বা ইউরোপিয়ানদের সাথে বিবাহের ফলে নিজেরাই হারিয়ে ফেলেন তাদের জাতির পরিচয়। এই আদিবাসীদের বেশীরভাগ জন্ম থেকেই বধিরতায় ভুগতেন, এই শারীরিক অক্ষমতা দুর করতে এরা একটি শারীরিক সংকেত ব্যবহার করতেন যাকে 'মার্থাস সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ' বলা হতো। ইউরোপিয়ান বসতির সম্প্রসারণের ফলে এদের মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রসার হয়। খ্রিস্টান ধর্মযাজকেরা এখানে স্কুল কলেজ, গির্জা ও হাসপাতাল তৈরি করে এদের শিক্ষিত করে তোলেন। এই দ্বীপের নামকরণ হয়েছিল Gosnold এর মেয়ে বা পুত্র বধু মার্থার নামে, ঘটনাক্রমে দুজনেরই নাম মার্থা ছিলো। এর আগে এই দ্বীপকে ম্যাসাচুসেটস ভাষায় 'নোয়েপ' বলে ডাকা হতো, যার মানে তরঙ্গের মধ্যে দ্বীপ। ১৬০০ শতকে বিশ্বব্যাপী তিমি মাছের শিকার বৃদ্ধি পায়। তিমির শরীরের তেল ও চর্বি আলো জ্বালানোর কাজে ব্যবহৃত হতো। ফলে মার্থাস ভাইন ইয়ার্ডকে তিমি শিকারের কেন্দ্র করা হয়। পরবর্তীতে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়াতে খনিজ তেল আবিষ্কার হলে এর চাহিদা কমে যায় এবং এই রমরমা ব্যবসা ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যায়। এই দ্বীপ ঘিরে আছে তিমি শিকারীদের গ্রাম এর মধ্যে এখন কিছু লোক জীবিকা হিসেবে মাছ ধরেন, বাদ বাকি পরিত্যক্ত। একশ বর্গ মাইলের এই ছোট্ট দ্বীপ গত একশ বছর ধরে নিউ ইংল্যান্ড ও উত্তর আমেরিকার একটি জনপ্রিয় সমৃদ্ধশালী গ্রীষ্মাবাস। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিদের পছন্দের ছুটি কাটানোর স্থান, জন এফ কেনেডি, বিল ক্লিনটন ও বরাক ওবামা এখানে এসে থাকতেন। জন এফ কেনেডির স্ত্রী এখানে Acquinnah জনপদে একটি ফার্ম হাউসের মালিক ছিলেন ও অনেক দিন এখানেই কাটিয়েছেন। ১৬ জুন ১৯৯৯ এই দ্বীপের উপকূলে ভেঙে পড়েছিল একটি নিজস্ব বিমান যার চালক ছিলেন জুনিয়র জন এফ কেনেডি , একই সাথে মারা যান তার স্ত্রী ও বোন তারা এখানে ছুটি কাটাতে এসেছিলেন। এই দ্বীপে সাতটি জনপদ আছে; এডগার টাউন, ওক ব্লাফ, টিসবেরী, মেনেমেশে, চিলমার্ক, একুইনা ও ওয়েস্ট টিসবেরী। জনসংখ্যা মাত্র ১৬০০০, তবে গ্রীষ্মের সময় তা বেড়ে দাঁড়ায় এক লক্ষ্যে। ১৯৭৪ সালে বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক স্টিফেন স্পিলবার্গ, এই দ্বীপে প্রথম শুটিং করেছিলেন সমুদ্রের নীচে তার বিখ্যাত ছবি "Jaws," এর। এই দ্বীপের দুটি গ্রাম মেনেমেশা ও চিলমার্কে, শুধু তাই নয় এই গ্রামের লোকেদের থেকে বেছে নিয়েছিলেন অভিনেতা ও পার্শ্বচরিত্রদের। এর পর Jaws 2, ও Jaws: The revenge এখানেই তৈরি হয়েছিল। পুরো দ্বীপটিই দর্শনীয় এর মধ্যে চারটি প্রাচীন লাইট হাউস যাদের কোনোটির বয়স ৩০০ বছরের বেশি এখনো কর্মরত। এর মধ্যে লাল ইটের তৈরি 'গে হেড ' লাইট হাউস ও সংলগ্ন ক্লীফ মুগ্ধ করে। সমুদ্রের তীরে এই ক্লীফ বিভিন্ন রঙের, শিল্পীদের দেখা যায় এখানে দাঁড়িয়ে ক্যানভাসে আঁকতে এই দৃশ্য আমরাও যতটুকু পারি দেখে মন ভরালাম। এখানেই আছে Acquinnah Cultural centre। পুরো দ্বীপটির দর্শনীয় স্থান গুলি ট্যুরিস্ট বাসে ঘুরতে চার ঘন্টার মতো সময় লাগে, এর মধ্যে বিশেষ কয়েকটি সমুদ্র সৈকত, মিউজিয়াম ও পুরাতন অট্টালিকা দেখার সুযোগ হয়েছে। এখানে আছে সার দেওয়া জিঞ্জার ব্রেড হাউস। সন্ধ্যা নামতেই সেজে ওঠে স্ট্র্যান্ড ও ওক ব্লাফ, তিনশ বছরের পুরনো হর্স অন হুইল এর মতন পানশালা। ওক ব্লাফ থেকে ভাড়া নেওয়া যায় নিজের পছন্দের জলযান চালক সহ বা চালাতে জানলে নিজের দায়িত্বে ঘুরে আসা যায় আটলান্টিক মহাসাগর কিছুক্ষণ বা কিছুদিনের জন্য। বেশির ভাগ পর্যটক এখানে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন, সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়ান, মাছ ধরেন, সমুদ্রের তীরে বসে রৌদ্রস্নান করেন, ছবি আঁকেন। এছাড়া আছে Kyacking, Yatching ও Ski এর মতো রোমাঞ্চকর খেলা। শীতের চারমাস এই শহরে বন্ধ হয়ে যায় হোটেল ও রেস্তোঁরাগুলি, মাত্র তিনটি জেনারেল স্টোর খোলা থাকে, শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মার্থাস ভাইন ইয়ার্ড।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.