Header Ads

সীমা ছাড়িয়ে হিমা, তাকে স্বাগত জানানোর জন্য অধীর আগ্ৰহে অপেক্ষা করছে অসমবাসী


পিনাক দত্তঃ
ট্ৰ্যাকে আসার খুব বেশিদিন হয়নি তাঁর। এই কিছুদিন আগেও ফুটবল মাঠে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। দারিদ্ৰের অসহ যন্ত্ৰণা মেটাতে ভাড়াটে ফুটবলার হিসেবে খেলেছেন। চার বা পাঁচশো টাকায়। ছেলেদের ম্যাচ হলেও অবলীলায় মাঠে নেমে পড়েছেন। সুঠাম পুরুষালি চেহারা তখন পাশে দাঁড়িয়েছে তাঁর।
বড়জোর দু'বছর। অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে জড়াতে শু করেন হিমা। তখনও ঠিক করতে পারেননি তাঁর ইভেন্টটা কী হবে। কেউ বলছে শৰ্ট ডিসট্যান্সে ভাল করবে ও। কেউ বলছে লং রানার শুরু করলেন ১০০ এবং ২০০ মিটার দিয়ে। আন্তঃজেলায় খানিকটা সাফল্যও পেলেও আত্মবিশ্বাসের সেই ঝলক দেখা যায়নি। 
একবছর আগে কেনিয়ার নাইরোবিতে অনূৰ্ধ্ব ১৮ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের পরই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। সেবার দুশো মিটারে অংশ নিয়েছিলেন হিমা। ফাইনালে গেলেও শেষ করেন পাঁচ নম্বরে। পদক না পেলেও নাইরোবির মাটিতেই হিমার জীবনের প্ৰথম সূৰ্যোদয় ঘটে। উজ্জীবিত প্ৰদৰ্শন করে সেই প্ৰথম লাইমলাইটে আসেন তিনি।
ক্ৰমশঃ ফেডারেশন কাপ আসে। ততক্ষণে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে। এক বা দুশো নয়, চারশো মিটারই তাঁর ইভেন্ট হবে। সৰ্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে হিমার হাতেখড়ি যার হাতে সেই তিনি নবজিৎ মালাকার, গুয়াহাটিতে আসার পর যার তত্ত্বাবধানে অ্যাথলিট হিসেবে তাঁর বেড়ে ওঠা সেই নিপন দাস এবং খোদ হিমা সবার সিদ্ধান্ত ছিল এটা। 
হিমা এখন থেকে চারশো মিটারেই নামবে। ব্যস শু হল অন্য এপিসোডের।  স্টাৰ্ট নিয়ে সমস্যা তাঁর শুরু থেকেই। কিন্তু সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে গতি বাড়াতে পারেন হিমা। এবং দুশো মিটারের পরও দেখা যাচ্ছে  অফুরন্ত প্ৰাণশক্তি তাঁর। ক্ৰমশ চারশো মিটারে দুরন্ত দেখাতে শুরু হল হিমাকে।
ফেডারেশন কাপের পর গুয়াহাটিতে ঘরের মাটিতে জাতীয় সিনিয়রেও ৪০০ মিটারে ট্ৰ্যাকে নামেন হিমা। এরপরই আসে সেই সন্ধিক্ষণ। ততদিনে আঠারো পেরিয়ে গেছেন হিমা। এবার সামনে অনূৰ্ধ্ব ২০ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। দিনকে রাত করে প্ৰস্তুতি হল। ফিটনেস ব্যাপারটা তাঁর জন্মগত। পাতিয়ালা সাই সেন্টারে তাই তাঁকে এনিয়ে বেশি খাটতে হয়নি। টেকনিক্যাল দিকগুলো ঠিক করে দেন সেখানকার কোচরা। আরও ধারালো হয়ে ওঠেন হিমা। 
স্টাৰ্টে এখন অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ তিনি।  কভারিং প্ৰথম থেকেই তার ষ্ট্ৰং পয়েন্ট। তাই ফিনল্যােণ্ড যাওয়ার আগে মানসিক দৃঢ়তা বেড়ে যায় তাঁর। যদিও তাঁকে নিয়ে খুব একটা আশা করেনি কেউ। এমনকী খোদ ফেডারেশনেও এনিয়ে ইতিবাচক কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু তামপেরেত ট্ৰ্যাকে নেমেই প্ৰমাণ করে দিলেন হিমা। সব সীমা ছাড়িয়ে যেতেই মাঠ ছেড়ে ট্ৰ্যাকের দিশা বেছে নিয়েছেন তিনি। 
চারশো মিটারে হিমার ব্যক্তিগত সেরা ৫১.১৩ সেকেণ্ড। জাতীয় সিনিয়রে এই রেকৰ্ড গড়েছিলেন তিনি। জুনের শেষ সপ্তাহে সসজাইয়ে হয়েছিল টুৰ্নামেন্ট। ৫১.৪৬  সেকেণ্ড সময় নিয়ে বৃহস্পতিবার ফিনল্যােণ্ড সোনা জেতেন। ৫১.৩২  সেকেণ্ড ছিল কমনওয়েলথে তাঁর প্ৰদৰ্শন। এবং এরপরও গোল্ডকোস্টে ছয় নম্বরে শেষ করতে হয় তাঁকে। গত এপ্ৰিলে হয়েছিল কমনওয়েলথ।
এপৰ্যন্ত কমনওয়েলসথ গেমস হিমার কেরিয়ারের সৰ্বোচ্চ স্তরের টুৰ্নামেন্ট ছিল। এবং জাতীয় সিনিয়র ছিল ব্যক্তিগত সেরা প্ৰদৰ্শনের মঞ্চ। কিন্তু এই দুটোর কোনওটাই বিখ্যাত করেনি তাঁকে। করতে পারেনি। কমনওয়েলথে ফাইনালে যাওয়াটাই একদিক থেকে বিশাল ব্যপার। কিন্তু পদক তালিকায় না থাকায় এড়িয়ে যায় প্ৰচার মাধ্যম। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ সাধারণ মানের টুৰ্নামেন্ট নয়, কিন্তু কমনওয়েলথের সঙ্গে এর তুলনা হয় না। বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ থেকে বাছাই অ্যাথলিটরাই কমনওয়েলথ, অলিম্পিক ইত্যাদির জন্য যোগ্যতাৰ্জন করেন। এগুলো মাপকাঠি প্ৰমাণের মঞ্চ।
এখন সামনে এশিয়ান গেমস। এশিয়াডে পারফরম্যান্স ধরে রাখতে পারলে তখন ভাবা হবে অলিম্পিকের কথা। হিমার পাখির চোখ কিন্তু সেদিকেই। এতদিন এনিয়ে মুখ খুলে কিছু বলেননি তিনি। কিন্তু জাতীয় সিনিয়রে শেষবার পিটি ঊষার সান্নিধ্য তাঁকে আরও  কঠিন করে তুলে। খোলস থেকে বেরিয়ে  আসেন হিমা। ফিনল্যাে` যাবার আগে প্ৰথমবার স্পষ্ট করে বলে যান হিমা। ‘অলিম্পিকই লক্ষ্য আমার। নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই এটা আমার।' দেশ-বিদেশের কোনও প্ৰতিপক্ষকেই যে তিনি আর রেয়াত করছেন না সে ইঙ্গিতও দিয়ে যান গুয়াহাটি ছেড়ে যাবার আগে।
কিন্তু সে পথ মসৃণ নয় মোটেও। মহিলাদের চারশো মিটারের বিশ্বরেকৰ্ড ৪৭.৬০  সেকেণ্ড। অলিম্পিক রেকৰ্ড ৪৮.২৫  সেকেণ্ড। সেই মানে পৌছাতে এখনও তিন  সেকেণ্ডের দূরত্ব পেরোতে হবে হিমাকে। এই তিন  সেকেণ্ড কিন্তু তিন যোজন পথের সমান। হিমা নিজেও জানেন এটা। আর জানেন বলেই ফোকাসড তিনি। ধারাবাহিক উন্নতির দিকে সৰ্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়েছেন। 
জাতীয় রেকৰ্ডের খুব কাছাকাছি এখন হিমা। মহিলাদের ৪০০ মিটারের জাতীয় রেকৰ্ড ৫১.০৫  সেকেণ্ড। .০৮  সেকেণ্ড এগিয়ে যেতে পারলে সেই ধাপও পেরিয়ে যাবেন তিনি।
অসম অ্যাথলিট হিসেবে হিমা প্ৰথম এই পথের পথিক নন কিন্তু। অসমে এর একটা  সংক্ষিপ্ত অথচ দীৰ্ঘ ইতিহাস আছে। অজুন ভোগশ্বের বয়া থেকে শুরু যে ট্ৰ্যাডিশন তার নবতম সংযোজন হিমা। ১৯৬৬ এশিয়ান গেমসে ৮০০ মিটারে সোনা জিতেছিলেন ভোগেশ্বর। এটা মোটামুটি সবারই জানা। কিন্তু এরপরও আরও এক বিশ্বমানের লং ডিস্টান্স রানার পেয়েছিল অসম। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচৰ্যার অভাবে অকালেই হারিয়ে যান তিনি। কিন্তু যেতে-যেতে পথটাও তৈরি করে দিয়ে যান।
অসমের বরদৈচিলা বলা হত তাঁকে। নাম ছিল তাঁর জুনমণি শইকিয়া। চারশো মিটারের অসম হাৰ্টথ্ৰব ছিলেন তিনি। ১৯৯১ কলম্বো সাফ গেমসে ৪-১০০ মিটার রিলেতে সোনাজয়ী ভারতীয় দলের অন্যতম সদস্যা ছিলেন তিনি। একবছর পর নতুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান জুনিয়র ট্ৰ্যাক ইভেন্টেও রিলেতে সোনা পান তিনি। সেবার নতুন রেকৰ্ডও গড়েন তাঁরা। এরপর বেজিং, মালয়েশিয়াতেও ভারতীয় দলের প্ৰতিনিধিত্ব করেন তিনি। মাজুলির বনগাঁও থেকে ওঠে আসা জুনমণি ক্ৰমশ বেড়ে উঠছিলেন। ১০০ এবং দুশো মিটারে জাতীয় স্তরে একাধিকবার নিজের প্ৰতিভার স্বাক্ষর রাখেন তিনি। অসম্ভব সম্ভাবনা নিয়েই ট্ৰ্যাকে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু মৃদুল দুঁয়ারাকে বিয়ের তিন বছর পর আচমকা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তিনি।
বেঁচে থাকতেও অবশ্য অসম অ্যাথলেটিক বা রাজ্য সরকারের কোনও সাহায্য পাননি। তখন স্পোৰ্টস অথরিটিও ছিল না। সাই থাকলেও সরকার, রাজ্য অ্যাথলেটিক বা ফেডারেশন থেকে যতটা পাওয়ার কথা ততটা পাননি, পাচ্ছেন না হিমাও। ফিনল্যাণ্ড কাণ্ডের পর এখন অনেকেই এগিয়ে আসছেন। অমুক নেতা, তমুক মন্ত্ৰী এক লক্ষ, দুলক্ষ। কিন্তু এসব প্ৰয়োজন ছিল আরও আগেই। এখন তো স্পনসর ছুটবে হিমার পেছনে। নাইরোবি যাওয়ার আগে ভাড়ার পয়সা ছিল না হিমার।
এবং জিতে আসার পরও কী করছে ফেডারেশন। হিমা ভাল ইংরাজি বলতে পারে না বলে কটাক্ষ করা হচ্ছে। এনিয়ে পরে যদিও ফেডারেশনের তরফে সরকারিভাবে মাপ চেয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটাই তো এদেশের নিয়তি। ফেডারেশনের এই মন্তব্য নিয়ে কেন কোনও প্ৰতিবাদ করেনি অসম অ্যাথলেটিক সংস্থা। অসম সরকার, আসু এরা তখন কোথায় ছিল। না, সমুজ্জ্বলের মতো বৰ্ষীয়ানরাও হিমাকে বাঙালি বলে ধরে নিয়েছেন। কলকাতার এক প্ৰথমসারির দৈনিক এমনটাই ছেপেছে। এ তো অপমান।
নগাঁওয়ের ধিংয়ের মতো প্ৰত্যন্ত একটা অঞ্চল থেকে উঠে আসার হিমাকে কতটা গুত্ব দিয়েছে অসমীয়া সংবাদমাধ্যম। এপ্ৰশ্নও উঠছে। কমনওয়েলথের পর থেকেই প্ৰশ্নটা আসতে শুরু করে। আর বৈদ্যুতিন মাধ্যম। এরা তো জানেই না, যে এই সেই হিমা যিনি কমনওয়েলথ গেমসের মতো আসরে ফাইনালের যোগ্যতাৰ্জন করেছিলেন। এরা তো জানেই জানেই না, জুনমণি শইকিয়ার কথা। 
ব্ৰাজিল, আৰ্জেন্টিনা, ফ্ৰান্স সহ বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া ৩২ টি দলের কজন ইংরাজিতে কথা বলেন? তাঁর কাজ তো গুছিয়ে কথা বলা নয়। ট্ৰ্যাকে নেমে জীবন বাজি রাখা। অলিম্পিক জিতে আসার পর মেরি কম, বিজেন্দর সবাই একমুখে, একসুরে বলেছিলেন, ‘পদক জেতার পর নয়, প্ৰস্তুতির সময় সাহায্যের প্ৰয়োজন সবচেয়ে বেশি। আর তখন পাওয়া যায় না কাউকে।' এভাবেই অংসখ্য-অগুনতি প্ৰতিভা এদেশে হারিয়ে যায়। সভ্যতার অতল তলে। ইতিহাস হাসে। হিমাও সেই ইতিহাসের অংশ না হয়ে যান এটাই আশঙ্কা। আর আশা। হিমার হার না মানা মানসিকতা। জেদ। শেষ দেখে ছাড়ার শপথ নিয়ে যে বসে আছেন অসমের নতুন বরদৈচিলা।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.