Header Ads

মায়াংয়ের যাদুর দেশে কিছুক্ষণ


শব্দ ব্ৰহ্মের সাধক তিলক হাজরিকা
অমল গুপ্ত, গুয়াহাটিঃ অসমের তীৰ্থচূড়ামণি বলে খ্যাত কামরূপ কামাখ্যা তন্ত্ৰ সাধনার শক্তিপীঠ বলে দেশবাসী জানলেও তন্ত্ৰ-মন্ত্ৰের প্ৰধানপীঠস্থান কিন্তু কাখ্যমাধাম-গুয়াহাটি নগরী থেকে ৭০-৮০ কিলোমিটার দূরবৰ্তী পবিতরা অভয়ারণ্যের উপকন্ঠের ছোট্ট জনপদ বুড়া মায়ং-এ।পবিতরা অভয়ারণ্য এক শিঙ্গ বিশিষ্ট গণ্ডারের চারণ ভূমি, রহস্যে ঘেরা বুড়া মায়ংকে ঘিরে রেখেছে। মায়াংয়ের যাদুকররা মানুষকে ভেড়া বানিয়ে দেয় জনশ্ৰুতি থাকা জনপদ মায়ংয়ে একদিন তন্ত্ৰ-মন্ত্ৰের সাধন ভূমি ছিল। আজ তা প্ৰায় সোণালী অতীত। এই জনপদে এখনও এক মিউজিয়াম টিকে আছে, হাজার খানিক গ্ৰন্থ আছে। আগর গাছের ছালে (বাকল) ‘কাইথালী' ভাষায় তন্ত্ৰ-মন্ত্ৰের কথা লেখা আছে। তা এখনও পাঠোদ্ধার করা যায় নি।শিলডুবি মায়াং লুনমাটি এলাকায় অবসর প্ৰাপ্ত শিক্ষক তিলক হাজরিকা বৰ্তমানে তন্ত্ৰ সাধনাকে জিইয়ে রেখেছেন। গত ৩ জুলাই আমরা কয়েকজন তন্ত্ৰসাধক তিলক হাজরিকার বাড়ীতে গিয়েছিলাম। তন্ত্ৰসাধকের অভিজ্ঞতার কথা জানতে। তার শিক্ষক ভাই কন্দৰ্প হাজরিকা আমাদের আপ্যায়ন করে বসালেন। পরে শুধু মাত্ৰ গামোছা-গেঞ্জি পরিধান করে প্ৰায় ৭৫ বছরের অবসর প্ৰাপ্ত শিক্ষক মায়াংয়ের একমাত্ৰ যাদুকর তিলক হাজরিকা এসে বসলেন। ড্ৰয়িং রুমে একটিমাত্ৰ আলমারি পুরনো কিছু বই-পত্ৰ রাখা আছে। অসম টাইপের বাড়ীর ডানদিকে ছোট্ট বিষ্ণু মন্দির, দুই পাশে দুই সিংহের প্ৰতিমূৰ্তি। শঙ্খশ্ৰী এল পি স্কুলের অবসর প্ৰাপ্ত শিক্ষক তিলক হাজরিকা জানালেন, বিষ্ণুই তাদের আরাধ্য দেবতা, সুদৰ্শনচক্ৰের মতো এত বড় মারনাস্ত্ৰ দুনিয়াতে নেই। তিনি অদ্ভূত কিছু কথা বাৰ্তা বললেন, আমরা মন্ত্ৰমুেগ্দ্ধর মতো শুনলাম। তিনি বললেন– ‘শব্দ হচ্ছে ব্ৰহ্ম, শব্দের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ স্থাপিত হয়। মানুষ যদি সেই শব্দ আত্মস্থ করতে পারে, তবে মানুষের সঙ্গে মানুেষর আত্মার মিলন ঘটে, মহামিলনের সৃষ্টি হয়। এই শব্দ ব্ৰহ্ম যদি কোনও মানুষ আত্মস্থ করতে পারে তবে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। মন্ত্ৰ এক সাধনা, ঠিক মতো উচ্চারণের মাধ্যমে শব্দ ব্ৰহ্ম প্ৰয়োগ করে মন্ত্ৰোচ্চারণের মাধ্যমে যে কোনও মারণ রোগের উপশম ঘটে।' শিক্ষাগুরু হাজরিকা আরও বলেন, ‘বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু তৰ্কে বহুদূর'– মনে প্ৰাণে বিশ্বাস না করলে কোনও কাজ হবেনা, সাধনার চাবিকাঠি হচ্ছে অসীম বিশ্বাস। অষ্ট্ৰেলিয়া, আমেরিকা, বাংলাদেশ, ভূটান, নেপাল প্ৰভৃতি দেশ বিদেশ থেকে মানুষ ছুটে আসছে আমার মতো গরিবের বৈঠকখানায় এই মন্তব্য করে হাজরিকা বলেন, শিক্ষায়-দীক্ষায়, বিজ্ঞানে এতো উচ্চমাৰ্গের দেশের মানুষ কেন আমার কাছে তন্ত্ৰ সাধনার পাঠ নিতে আসে- সম্প্ৰতি এক জাৰ্মান তরুণী এসে জানতে চাইলেন, সাধনা কি, কি ভাবে সাধনা করা যায়? প্ৰায় সারা বছর রহস্যে ঘেরা বুড়া মায়ংয়ের লুনামাটির প্ৰাক্তন শিক্ষকের বাড়ীতে ভীড় জমেই থাকে। সপ্তম-অষ্টম শ্ৰেণী থেকে সৰ্প বিদ্যায় হাত পাকানো তন্ত্ৰ সাধক তিলক হাজরিকা জানান, যে কোনও ধরণের বিষাক্ত সাপে কামরানো রোগীকে আমার কাছে আনলে তাকে ভালো করে তোলার ক্ষমতা আমার আছে। তবে রোগীর জ্ঞান থাকতে হবে এবং শরীর থেকে কোনও রক্ত না ঝড়ে। সাপে কাটা লক্ষণ দেখে বলে দিতে পারি কি প্ৰজাতির বিষাক্ত সাপে কেটেছে। তিনি বলেন, মায়াং অঞ্চলে সুরা বেজ, লক্ষ্মী বেজ নামে দুই পুরনো তন্ত্ৰসাধক ছিলেন মারা গেছেন। আপনার গুরু কে ছিলেন জানতে চাইলে ইতস্তত করে বলেন, নাম আমি বলবো না, তবে রহস্যে ঘেরা এক সাধক পুরুষের সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম। তিনিই আমার তন্ত্ৰ গুরু। উচ্চ শিক্ষিতা ৪ কন্যা ১ পুত্ৰের বাবা তিলক হাজরিকা শব্দ ব্ৰহ্ম, কানেক্টিভিটি, অত্যাধুনিক বিজ্ঞান প্ৰযুক্তির কথা বলছেন কিন্তু তার হাতে কোনও স্মাৰ্ট ফোন নেই, সাধারণ এক মোবাইলে দেশ বিদেশের মানুষের সঙ্গে কথা বাৰ্তা বলেন। বিভিন্ন রোগে আক্ৰান্তদের তিনি কেবল আয়ুৰ্বেদিক দেশজ জড়িবুটি ঝাড়ফুঁক করে রোগীকে সুস্থ করে তোলেন। অসমের প্ৰাক্তন রাজ্যপাল লোকনাথ মিশ্ৰ ছিলেন তিলক হাজরিকার বড় ভক্ত। লোকনাথ মিশ্ৰ প্ৰায়ই শিক্ষাগুরু হাজরিকাকে গুয়াহাটি রাজভবনে আমন্ত্ৰণ করে নিয়ে যেতেন। প্ৰাক্তন প্ৰয়াত রাজ্যপাল মিশ্ৰও তন্ত্ৰ-মন্ত্ৰ করতেন। এক বার স্কুটার দূৰ্ঘটনার পর আমি প্ৰাক্তন রাজ্যপাল লোকনাথ মিশ্ৰের কাছে গিয়েছিলাম, তিনি আমার হাতের ব্যাথার স্থানে ঝাড়ফুঁক করে জিজ্ঞাসা করলেন– একটু ভালো হয়েছে তো? আমি আর কি জবাব দেবো– রাজ্যপালকে বললাম একটু কমেছে, কারণ রাজ্যপালকে কি মিথ্যা বলা যায়? ওই দিন আমার সঙ্গে ছিলেন সুপ্ৰীমকোৰ্টের বিশিষ্ট আইনজীবি জয়দ্বীপ মুখাৰ্জি। তিনি তার হাঁটুর ব্যাথার কথা জানালেন– তিলক হাজরিকা মন্ত্ৰ উচ্চারণের সঙ্গে জড়িবুটির তেল মালিশ করে দিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাথা কি একটু কমেছে? মুখাৰ্জি জবাবে জানান, অনেকটা কমে গেছে। আমার হাটুর ব্যাথাতেও তিনি তেল মালিশ করে একই কথা জিজ্ঞাসা করলেন– আমি নিশ্চুপ থাকলাম। আমরা যখন ফিরছি রহস্যে ঘেরা মায়ং জনপদে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, তুলসীতলায় শঙ্খ বাজানোর শব্দ কানে এলো, যা শব্দ ব্ৰহ্ম, সেই শেব্দ আত্মার মিলন ঘটে। শব্দ ব্ৰহ্মের সাধক তিলক হাজরিকার বাড়ী থেকে আমরা অনেক দূরে চলে এলাম।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.