Header Ads

গুড় ও লামডিং শহর

জয়শ্ৰী আচাৰ্য্য


তিনদিক পাহাড় ঘেরাছোট্ট একটি শহর লামডিং৷ ১৮৯৯ সনে লামডিং রেল জংশন স্থাপনের মাধ্যমে শহরের পত্তন হয়৷ সে সময়ের প্ৰাকৃতিক পরিবেশ এখনকার মতো ছিল না৷ ঘন জঙ্গলে আবৃত একটি পাহাড় ঘেরা অঞ্চল বললে অত্যুক্তি হয় না৷ ১৯০১ সনে তৎকালীন ব্ৰিটিশ সরকারের হাত ধরে লামডিং-তিনসুকীয়া রেল সম্প্ৰসারিত হলেও দেখা দিয়েছিল বিভিন্ন ধ্বণের সংকট৷ জলের সমস্যাতো বটেই, উপযুক্ত রেলকৰ্মীও ছিল না৷ তাই বাধ্য হয়ে রেল প্ৰশাসন বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং তৎকালীন অবিভক্ত বাংলাদেশ থেকে লোক এনে রেলে নিয়োগ করে৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা সহ নোয়াখালি জেলা থেকেই প্ৰচুর সংখ্যক বাঙালি যেমন এই শহরের পাৰ্শ্ববতী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে, তেমনি বিহার থেকেও৷ রেল বিভাগ ছাড়াও সমাজ শহর গড়ে ওঠার ক্ষেত্ৰে বিহারি সম্প্ৰদায়ের অবদান ছিল প্ৰচুর৷ তাদের সঙ্গে আসেন তাদের আত্মীয় পরিজনরাও৷ ধীরে ধীরে পশ্চিম লামডিং ও দক্ষিণ লামডিং অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় এরা বসবাস শুরু করেন, জীবিকা হিসাবে বেছে নেন চাষ-বাসকে৷ কিন্তু বাধ সাধল জল৷ পাহাড়ি অঞ্চলে যদিও বা ‘নদী’ নামে পরিচিত কয়েকটি নালা আছে, সেগুলিতে বৰ্ষা ঋতু ছাড়া বছরের প্ৰায় বেশিরভাগ সময়েই জল থাকে না৷ তাই চাষাবাদের নমুনাও পাটে যায়৷ পাহাড়ি অঞ্চলে কম জলে ইক্ষুচাষই উপযুক্ত৷ শুরু হলো পথ চলা৷ স্বাধীন ভারতে তৎকালীন অসমের প্ৰধানমন্ত্ৰী (বৰ্তমান মুখ্যমন্ত্ৰী) গোপীনাথ বরদলৈর সময় উৎপাদিত ইক্ষুর বেশির ভাগই পাঠানো হতো কামপুর চিনির কলে৷ তারপর বিভিন্ন কারণে সেই রপ্তানি কমে যায়, একসময় বন্ধ হয়ে যায় কলও৷ চাষীরাও দেখলেন গুড় উৎপাদনে মুনাফা বেশি৷ শুরু হলো আরেক নতুন পথ চলা৷
রেল শহর লামডিং মূলত গড়ে উঠেছে রেলকেই কেন্দ্ৰ করে৷ তবে তারপর যে ব্যবসাটা স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে, তা হলো গুড়ের ব্যবসা৷ লামডিঙের পূৰ্বেস্থিত (নেপালিবস্তি) খাঙারগাঁও, ননকে বস্তি পশ্চিমে শাস্ত্ৰীগাঁও, জরংদিসা - ২, খাঙার বস্তি, হাতিখালি-১, হাতিখালি-২, দক্ষিণে হংসনালা, বাংলাবাজার, জরংদিসা-১, আমটিলা, কাছারি গাঁও, খাঙার গাঁও, লাল চরাই প্ৰভৃতি এলাকায় প্ৰচুর পরিমাণে আখের চাষ হয়৷ তবে তা সম্ভব হাড়াভাঙা খাটুনির ফলে৷ ৩নং হাতিখালির নন্দলাল যাদব জানান ফাুনমাসে এর বীজ বপন করা হয়, ফসল কাটা হয় কাৰ্তিক মাসে৷ বৰ্ষার ওপরেই চাষীদের নিৰ্ভর করতে হয়৷ আখ চাষে খুব বেশি জলের প্ৰয়োজন হয়না বলে চাষীরা আখ চাষই বেশি আগ্ৰহী৷ তবে বৃষ্টি না হলে অনেক অসুবিধার সন্মুখীন হতে হয়, ফলে মহাজনদের থেকে ধারে নেওয়া অৰ্থ ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না৷ ফলে কখনও কখনও জমি বন্ধক রাখতে হয়৷ সেসময় কষ্টের আর সীমা থাকে না৷
ভালো গুড় ৩৫ টাকা দামে এবং ২ নং গুড় ২৮ টাকা দরে রপ্তানি করা হয় বলে জানান গুড় ব্যবসায়ী দ্বিপেশ নাগ৷ মোট গুড়ের ৮০ শতাংশই যায় আপার আসামের বাগানগুলোতে৷ উল্লেখ্য ভালোগুড় খাওয়ার জন্য এবং ২ নং গুড় দিয়ে সুরা তৈরি করা হয়৷ খাওয়ানো হয় গৃহপালিত জন্তুদেরও৷ দ্বিপেশ নাগ জানান ১০ কুইন্টেল আঁখে এক কুইন্টল গুড় হয়৷ এক একটি পাঞ্জাব বডি লরিতে ১৮ টন করে গুড় আপার অসমে পাঠানো হয় এবং এভাবে প্ৰতি সিজনে ৩৪ শ গাড়ি গুড় আপার অসমে রপ্তানি করা হয়৷ বছরের এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন চাষীরা৷ এর মধ্যে যদি খরা হয় তবে পাহাড়ি অঞ্চলে জলসেচের ব্যবস্থা নাথাকায় চাষীদের জীবন যাত্ৰায় কিরকম প্ৰভাব পড়ে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ ফসল কাটা হয়ে গেলে পরে কোন কোন জমিতে বেগুন, কাঁচালঙ্কা চাষ হয় যদিও বৃষ্টি না থাকলে কোন সুবিধা করতে পারে না চাষীরা৷
এই রেল শহরে তিন চতুথাংশই গ্ৰামাঞ্চল৷ তাই স্বভাবতই গ্ৰামাঞ্চলে ভোটারের সংখ্যা বেশি৷ কিন্তু ভোটের পূৰ্ব সময় ছাড়া আর কোন নেতা মন্ত্ৰীই ওদিকে মাড়ান না৷ ফলে সরকারি কোন সুযোগ সুবিধার কথা গ্ৰামবাসীরা ভাবতেও পারেন  না৷ ‘নদী’ নামে যে নালাগুলো আছে সেগুলো থেকে ১০০ ফুট পৰ্যন্ত জল টেনে নিয়ে যান চাষীরা নিজেদের কষ্টে অৰ্জিত মেশিন দিয়ে, তাও সংখ্যায় সীমিত৷ তবে পূৰ্ববতী বিজেপি বিধায়ক সুশীল দত্ত কিছু কুয়ো খনন করিয়েছিলেন দক্ষিণ লামডিং ও পশ্চিম লামডিং এলাকায়৷ লামডিঙের সবচেয়ে উঁচু জনবসতিস্থান পূৰ্ব লামডিং এর গনেশ টিলার জনজীবন দুঃৰ্বিসহ হয়ে ওঠে শীতকালে৷ ননকে বস্তির স্বপন দাস, বাবুল দাসরা জানান পূৰ্ববতী বিধায়ক স্বপন কর কিছু কুয়ো ও পাকা রাস্তা নিৰ্মাণ করে দেওয়ায় গুড় বাজারে নিয়ে যেতে খুব সুবিধাই হয়েছে৷
গুড় তৈরিতে ব্যস্ত বাবুল দাস জানান ২০০ লিটার আখের রস থেকে ৫০ কেজি গুড় হয়৷ আর ১নং গুড় অৰ্থাৎ খাবারের গুড় হয় ৮০ কেজি৷ খাবারের গুড় থেকে ১নং গুড়েই মুনাফা বেশি, তাঁর স্ত্ৰী মালতী দাস জানান বছরের ঐ বিশেষ সময়টার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন তারা৷ ছেলে মেয়ের জামাকাপড় কিনে দেওয়া, মুদির দোকানের ধার পরিশোধ করা আর ভাগ্য নিৰ্দয় হলে আখে পোকা ধরে যায় অতি বৃষ্টির ফলে৷ তাই একটুও নষ্ট করতে চাননা বাবুল দাসের পরিবার৷ তাই নব ভাতৃবধূ অনিতা দাসও হাত বাড়ায় গুড় তৈরিতে৷
তবে প্ৰায় প্ৰতিবছরই আখের রস বের করতে গিয়ে চাষীদের দুৰ্ঘটনাগ্ৰস্ত হতে হয়৷ প্ৰায় প্ৰতি বছরই ৫ থেকে ৭ জন এই ধ্বণের ছোট বড় দুৰ্ঘটনার বলি হন৷ কেউ হারিয়েছেন আঙুল, কেউবা আবার পুরো হাতটাই৷ প্ৰায় দশবারো বছর আগে খাঙার গাঁওয়ের এক কিশোরী শোভারাণী দাস আখের রস বের করতে গিয়ে মাথার চুল ঢুকে যায় মেশিনে, চুলসহ মাথার খুলির পুরো চামরাটাই উঠে আসে, দিনমজুর বাবা জীবন দাস রক্তাক্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে৷ মালিকের দয়ায়ও গ্ৰামবাসীদের সহযোগীতায় প্ৰাণে বেঁচেগেলেও মাথার খুলির প্ৰায় অংশই আর মাংসে পূৰ্ণ হয়নি৷ চোখ দুটো ওপরের দিকে উঠে গেছে৷ দশবছর পর এক যুবক ভালোবেসে তাকে বিয়ে করলেও এক বছর যেতে না যেতেই তার উপর অত্যাচার শুরু হয়৷ একটি শিশু সন্তান কোলে নিয়ে শোভা আজ অসহায়৷ লামডিঙের একটি মহিলা সংস্থা ‘নন্দিনীর’ প্ৰবল ইছা সত্বেও এই ঘটনাটি বৰ্তমান সরকারের একমাত্ৰ মহিলা মন্ত্ৰী  প্ৰমীলা রাণী ব্ৰহ্মর দৃষ্টি আকৰ্ষণ করানো যায়নি৷ চেষ্টা চলছে, যাই হোক এতো শুধু একজন শোভা, এরকম কত শোভার মা-বাবা-ভাই-বোন-স্বামীকে আঙুল, হাত খোয়াতে হয়েছে গুড়ের মেশিনে তার খবর কেউ রাখেনা৷

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.