Header Ads

বৈশাখী পূর্ণিমায় জন্ম লগ্নে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্তিজী সম্পর্কে দুচার কথা

 

                                                 ছবি, সৌঃ আন্তর্জাল, গ্রন্থ প্রণেতা প্রভাতরঞ্জন সরকার।

                                                            খগেনচন্দ্র দাস
                
                     আজ একবিংশ শতিকায় দাঁড়িয়ে যদি বলা যায় যে, 'রবীন্দ্রনাথ বেঁচে আছেন', কারও কারও কাছে অদ্ভুত ঠেকলেও কথাটা সত্যি। শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন সক্ৰেটিছ, টলষ্টয়, আরও অনেকেই জীবিত অবস্থার চেয়েও প্রবলভাবে জীবিত--- তাঁরা জীবিত গ্রন্থাগারে, তাঁদের রচিত গ্রন্থের মধ্যে। আজ আমরা যাঁর রচিত গ্রন্থের উপর আলোকপাত করতে চাই তিনি ১৯৯০ সনের ২১ শে অক্টোবর থেকে সশরীরে আমাদের মধ্যে না থাকলেও তিনিও জীবিত,তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে।
                  'ফলেন পরিচীয়তে' বলে একটি বহুল প্রচলিত বাংলা বাগধারা রয়েছে। A tree is known by it's fruits. এটিও অনেকেই ব্যবহার করেন। ফল দেখে গাছ চেনা গেলেও সেই ফল সম্পর্কে সম্যক ধারণা ততক্ষণ হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই ফলের স্বাদ চেখে দেখা হচ্ছে। আর এই বাগধারা শুধু গাছের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য,এমন নয়। ব্যষ্টির ক্ষেত্রেও সমানভাবেই প্রযোজ্য। এমনকী সেই ব্যষ্টির শারীরিক উপস্থিতিও গভীরভাবে অনুভব করা যায় তাঁর রচনার মধ্যে। আর সেই অনুভব শরীরি অনুভবের চেয়েও তীব্রতর। বস্তুত ব্যষ্টির যথার্থ মান নির্ণয়ই হয় তাঁর লিখিত গ্ৰন্থ ও জীবনজোড়া অনুষ্ঠিত কর্মকাণ্ডের নিরিখে। তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা- নেত্রীর মনগড়া বক্তব্যের আধারে  নয়।
                
         আজ আমরা প্রভাতরঞ্জন সরকারের  জন্মদিনের শততম বর্ষপূর্তি উদযাপনের সময়ে তাঁর রচনাসম্ভারের মধ্য থেকে কয়েকটিকে কেন্দ্র করে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করব।
                 তাঁর পিতৃদত্ত নাম প্রভাতরঞ্জন সরকার। কিন্তু তিনি ভারতীয় ধর্মীয়সংস্কৃতি পরম্পরার ধারক হিসেবে  শ্রীশ্রীআনন্দমূর্তিজী নামেই অধিক পরিচিত। তাঁর জন্ম   ইং১৯২১ সনের বৈশাখী পূর্ণিমার পুণ্য প্রভাতে তদানীন্তন বিহার রাজ্যের রেল শহর জামালপুরে। সেখানেই স্কুল শিক্ষা শেষ করে কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় আইএসসি পাশ করেন। পারিবারিক কারণে তাঁর প্রথাগত শিক্ষা সেখানেই সমাপ্ত হয় এবং একাউণ্টেণ্ট হিসেবে জামালপুরের রেল বিভাগে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। রেলে কর্মরত অবস্থাতেই ১৯৫৫ সনের ৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন 'আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ', আজ বিশ্বময় যার বিস্তৃতি। তারপর থেকে ১৯৯০ সনের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে রচনা করেন দুই শতাধিক গ্রন্থ।অবশ্য ১৯৭১ থেকে ১৯৭৮ এই সময়টুকু সরকারের বদান্যতায় কেটেছে কারাগারে। সুতরাং আক্ষরিক অর্থেই তাঁর গ্রন্থ রচনার সময় সব মিলিয়ে মাত্র সাতাশ বছর। এই সাতাশ বছরের মধ্যেই চিকিৎসা থেকে কৃষিকথা, সৃষ্টির উৎস সম্পর্কিত দার্শনিক গ্রন্থ 'আনন্দসূত্রম্' থেকে প্রাণের উৎস সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক বিষয় সম্বলিত 'মাইক্রোবাইটাম্', সমাজের উৎপত্তি ও বিকাশ বিষয়ক গ্রন্থ 'মানুষের সমাজ' থেকে  সমাজের  চলার সঠিক দিকনির্দেশনামূলক গ্রন্থ 'চর্যাচর্য', ভাষাতত্ব, ব্যাকরণ,নাটক,গল্প, শিশু সাহিত্য ইত্যাদি থেকে পাঁচ সহস্ৰাধিক সঙ্গীত,সব মিলিয়ে এক বিপুল সাহিত্যসম্ভার। এ যেন  বৈদিক ঋষির উক্তির মত--- "অভ্রাদ্ বৃষ্টিরিবাজনি" শ্রাবণের অবিশ্রান্ত ধারার মত নেমে এসেছে প্রভাতরঞ্জনের সাহিত্য।
            বেদের ঋষি বলেছেন--- "বায়ুরনিলম, খেদমিদং ভস্মান্তং শরীরে কৃতং স্মর ক্রুতং স্মর।" এই দেহ একদিন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যাবে, থেকে যাবে কর্মরাজি যা ধরা থাকবে তাঁর কর্মকাণ্ডে, জীবনচর্যায়, পুস্তকে। সমাজকে সঠিক পথ দেখাতে আমরা কেন  পুস্তককে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি সে বিষয়ে বিংশ শতাব্দীর এক বলিষ্ঠ লেখক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন---"যে জাতির যত বেশি লোক যত বেশি বই পড়ে, সে জাতি তত সভ্য----।" ( প্রমথ চৌধুরী,বই পড়া প্রবন্ধ) তা বলে যে কোন বই পড়ে একটা জাতি সভ্য হতে পারে না, বই অবশ্যই উচ্চ মানদণ্ডসম্পন্ন হতে হবে।
                     এ প্রসঙ্গে আজ আমরা প্রভাতরঞ্জন সরকারের দুয়েকটি বইয়ের উল্লেখ করব। প্রথমেই "জীবন বেদ", কলেবরের দিক থেকে অন্যূন চল্লিশ পৃষ্ঠার একটি ক্ষুদ্রকায় পুস্তিকা,যাতে রয়েছে পতঞ্জলির অষ্টাঙ্গ যোগ শাস্ত্রের প্রথম দুই চরণ 'যম-নিয়ম' এর বিস্তৃত বাস্তব ও ব্যবহারিক বিশ্লেষণ। যাকে আমরা পতঞ্জলি যোগসূত্রের ভাষ্য হিসেবেও দেখতে পারি। আজকাল যোগ চর্চার প্রতি মানুষের প্রবল আগ্রহ রয়েছে।যাঁরা যোগ অভ্যাস করেন বা যোগ সম্পর্কে আগ্রহী তাঁদের জন্য অবশ্য পাঠ্য এই বই। "অহিংসা" যোগ সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। এই অহিংসা সম্পর্কে শ্রী সরকার যে ব্যাখ্যা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তা মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের বুকে কুড়োল বসিয়েছে। আমাদের স্থির বিশ্বাস এই বইয়ে বর্ণিত যোগসাধনার প্রাথমিক পাঠসমূহ যেমন অহিংসা,সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ ইত্যাদির বিষয়ে যোগ অভ্যাসকারীর ধারণাই বদলে দেবে।
                "এক মানব সমাজ"  বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত গ্রন্থকারের পাঁচটি প্রবচনের একটি সংকলন গ্রন্থ। শ্রীসরকার তাঁর এই প্রবচনগুলির মধ্য দিয়ে যুক্তিসহকারে তুলে ধরেছেন যে, কীভাবে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ একই উৎস থেকে এসেছে এবং ধর্ম,বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি, পোষাকপরিচ্ছদ সংক্রান্ত বিভেদগুলো মানুষেরই তৈরি। এই বিভেদগুলো কৃত্রিম,অবাস্তব, অর্থহীন ও ক্ষুদ্র স্বার্থ প্ৰণোদিত। এই সমস্তকিছুকে অতিক্ৰম করে পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে এক সূত্রে গাঁথার পথ নির্দেশনা রয়েছে  এই পুস্তকে।
                  "নব্যমানবতাবাদ"--- প্রভাতরঞ্জন সরকারের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার।( Discovery নয় Invention.) বিষয়টি নিউটনের মধ্যাকৰ্ষণ শক্তি আবিষ্কারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বলে আমাদের মনে হয়। মধ্যাকৰ্ষণ আবিষ্কৃত না হলে যেমন আজকের অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই সম্ভব হতো না তেমনই "নব্যমানবতাবাদ" ছাড়া আগামীদিনে মানব সভ্যতার প্রগতির কথা কল্পনাও করা যাবে না। হ্যাঁ,একথাও অস্বীকার করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই যে এই নব্যমানবতাবাদের বীজ নিহিত ছিল ঈষোপনিষদের মধ্যেই। যেখানে বেদের ঋষি বলেছেন--- "ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ। তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বীদ্ ধনম্।।" (ঈষোপনিষদ ১/১) এটি আকরিক সোনা। প্রভাতরঞ্জন সরকার এই আকরিক সোনা দিয়েই গড়ে তুলেছেন তাঁর অসামান্য দর্শন "নব্যমানবতাবাদ"। যার মূল বক্তব্য পৃথিবীর সমস্ত কিছুর অস্তিত্বই একসূত্রে গাঁথা। মানুষ- পশু-লতাগুল্ম- স্থাবর জঙ্গম প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সঙ্গে ওতপ্ৰোতভাবে সম্পর্কিত। এদের মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ সুতরাং মানুষের পক্ষে, কোনকিছুকেই উপেক্ষা, অবজ্ঞা,অবহেলা,অবদমন করে চলা উচিত নয়,সম্ভবও নয়। এই সমস্তকিছুর প্রতি যথোচিত আচরণ করে,যত্ন নিয়ে প্রত্যেককেই সঙ্গে নিয়েএগিয়ে যেতে হবে,তবেই মানুষের সভ্যতা ফুলে ফলে সর্বতোভাবে বিকশিত হবে।
               ন'টি গ্রন্থ সম্বলিত "অভিমত" শিরোনামের একটি সিরিজ যেখানে-----সমাজ, রাষ্ট্র,নীতিবিজ্ঞান,আধ্যাত্মিকতা,শিল্প,ইতিহাস,নন্দনতত্ব,পুরাতত্ব ইত্যাদি বিষয়ে লেখক তাঁর গভীর প্রজ্ঞা সঞ্জাত অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
           "প্রভাতরঞ্জনের ব্যাকরণ বিজ্ঞান",  দেড় হাজার পৃষ্ঠার তিনটি খণ্ড যেখানে লেখক ভাষার উৎপত্তি,বৈচিত্র্য, বাংলা ও সংস্কৃতের ভাষাগত ধ্বনি বিজ্ঞান,বাংলা শব্দসম্ভারে বিদেশী শব্দ, বাংলায় শব্দ তৈরির  প্রবণতা ইত্যাদি বহু বিষয়ের ওপর বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। বাংলাভাষার ছাত্র অধ্যাপকদের সংগ্রহে রাখার মত বই।
            লঘুনিরুক্তঃ বাংলা বাঙালির মাতৃভাষা,তথাপি আমরা বহু বাংলা শব্দের ব্যুৎপত্তি,ভাবারূঢ়ার্থ- যোগারূঢ়ার্থ, শব্দের সঠিক ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে চার হাজার শব্দের ব্যুৎপত্তি ও অর্থ নির্ণয় করেছেন। বইখানি ইতোমধ্যেই বহু বিদগ্ধ ভাষাতাত্ত্বিকের ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে।
           বর্ণবিচিত্রাঃ আট খণ্ডের সিরিজে একেকটি বর্ণের উৎস, ভূমিকা,উচ্চারণ,তৎসম-তদ্ভব, দেশজ এবং বিদেশী শব্দে সংশ্লিষ্ট অক্ষরটির ব্যবহার নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন।
       শব্দচয়নিকাঃ ছব্বিশ খণ্ডের এই সিরিজে লেখক প্রতিটি শব্দের উদ্ভবের পেছনের ইতিহাস,অঞ্চলভেদে একেকটি শব্দের বিবর্তন ও প্রয়োগ সম্পর্কে  অসাধারণ আলোচনা করেছেন। এই আলোচনা প্রসঙ্গে অসংখ্য গল্পের অবতারণা করেছেন।
          বর্ণবিজ্ঞানঃ তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্র,গবেষক, অধ্যাপকদের জন্য একটি অনবদ্য গ্রন্থ। রয়েছে আধ্যাত্মিক ও  অর্থনৈতিক দর্শন সম্পর্কিত গ্রন্থ। শ্রীকৃষ্ণ ও সদাশিব ভারতীয় অধ্যাত্ম জগতের দুই পুরোধাপুরুষের জীবন ও কর্ম নিয়ে দুটি গ্রন্থ "নমামি কৃষ্ণ সুন্দরম্" ও "নমঃশিবায় শান্তায়"।
            মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলির নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করেছেন "মহাভারতের কথা" শীর্ষক গ্রন্থে।
       সাতাশ খণ্ডের "সুভাষিত সংগ্রহ", বত্রিশ খণ্ডের "আনন্দ বচনামৃতম্" ইত্যাদি। প্রভাতরঞ্জন সরকারের চিন্তাধারার আলোচনা, সমালোচনা, বিচার বিশ্লেষণ করতে অথবা তাঁকে জানতে, ভালবাসতে,  প্রশস্তি গাইতে তাঁর রচনাবলীর সম্যক অধ্যয়নের কোন বিকল্প নেই।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.