Header Ads

উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন ও কিছু ভাবনা

শঙ্খশুভ্র দেববর্মণ

এবার গুয়াহাটিতে সপ্তম উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় বাংলা লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনের এক সান্ধ্য অনুষ্ঠানে কিছুক্ষণের জন্য থাকতে পেরেছিলাম। বেশ ভালও লেগেছিল সেই অনুষ্ঠান। তিনদিনের এই সম্মেলন শুরু হয়েছিল ২২ ডিসেম্বর। এর সপ্তাহ খানেক আগে প্রিয় উষাদা (উষারঞ্জন ভট্টাচার্য) ফোনে আমায় ২৩ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় সম্মাননা অনুষ্ঠানে থাকার জন্য বলেছিলেন। মঞ্চে আমার ভূমিকা বিশেষ কিছুই না; গুণীজনদের মানপত্র এবং উত্তরীয় তুলে দিতে হবে। অনুষ্ঠানে আদৌ উপস্থিত থাকার সময় পাবো কিনা সে ব্যাপারে সংশয় ছিল। কেননা পরদিন অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর সকালের ফ্লাইটে যেতে হবে দিল্লি। অতি গুরুত্বপূর্ণ অফিশিয়াল মিটিং। অনারেবল ইউনিয়ন মিনিস্টার ফর ট্যুরিজম'এর মিটিং। প্রয়োজনীয় নোট, কাগজপত্তর গুছিয়ে নিতেই এদিকে বেলা কাবার! এর মধ্যে যথারীতি 'ভিজিটার'দের স্রোত। সব সামলে শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যেবেলায় সাউথ পয়েন্ট স্কুলে আসতে পেরেছিলাম। সপ্তম উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় বাংলা লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনের মঞ্চ এখানেই। আন্তরিকতায় খামতি ছিল না কোথাও। সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যেই উদ্যোক্তাদের এমন নিখুঁত আয়োজন মুগ্ধ করল। মনে পড়ছিল তখন অনেক কথাই। আমি হলদিয়া সাহিত্য উৎসব এবং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সাহিত্য উৎসব বলে খ্যাত জয়পুর সাহিত্য উৎসবেও অংশ নিয়েছি। জয়পুর সাহিত্য উৎসবের কথা না হয় কল্পনার বাইরে; কিন্তু আমাদের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় বাংলা লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন কী আগামী দিনে কম সে কম হলদিয়া সাহিত্য উৎসবের মতো ব্যাপ্তি পেতে পারে না! উত্তরপূর্ব ভারতে এখন ধীরে হলেও শিল্পায়ন শুরু হয়েছে। গুয়াহাটিতেই খুলেছে বিশ্বের অনেক খ্যাতনামা ব্র্যান্ডেড কোম্পানি তাদের প্রতিষ্ঠান; গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের পাঁচ তারকা হোটেল। উত্তরপূর্ব ভারতে ব্যবসারত এমন বৃহৎ শিল্প সংস্থাগুলির স্পনশরশীপ নিয়ে ভবিষ্যতে এই সাহিত্য সম্মেলন করা যায় কিনা উদ্যোক্তারা ভেবে দেখতে পারেন। জানি এতে আঞ্চলিক সাহিত্যের বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক স্তরে জলঘোলা হতে পারে। অনেকেই বলতে পারেন, শুধু বাংলা কেন - ককবরক কিম্বা নাগা সাহিত্যে নিয়ে সম্মেলন হবে না কেন। যথোচিত এই প্রশ্ন। সমস্যার এবম্বিধ সমস্যার সমাধান সম্ভব কীসে এই দিকটি নিয়েও তখন ভাবতে হবে। মোদ্দা কথা, উত্তরপূর্ব ভারতের বাংলা সাহিত্যের বিকাশের জন্য; অঞ্চলের অন্যান্য ভাষায় রচিত সাহিত্যচর্চার ব্যাপকতার জন্য - স্পনশরশীপ অবশ্যই দরকার।

 মার্কেট এখন এক বাস্তব। মার্কেট নিয়ে ছুঁৎমার্গীয় মানসিকতা তাই পরিত্যাজ্য। ছাড়তে হবে চিরায়ত পুঁজিবাদী আগ্রাসনের তত্ব। রক্ষণশীল মানসিকতা এই সময়ে গ্রহণযোগ্য নয়। এই ধারণাও অমূলক যে, বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের স্পনশরশীপ অর্থাৎ পৃষ্ঠপোষকতা নেওয়া মানেই নিজের সত্তা বিকিয়ে দেওয়া। ভুললে চলবে না পৃথিবীর সর্বত্র সাহিত্য মেলা কিম্বা উৎসব কিন্তু আজকাল স্পনশরশীপের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। আমাদের অঞ্চলে স্পনশরশীপের ফলে বাড়বে সাহিত্য সম্মেলনের গ্ল্যামার। বৃদ্ধি পাবে এতে আমাদের সাহিত্যকৃতির সমাদর। বাড়বে গাম্ভীর্য আর আভিজাত্য। উত্তরপূর্ব ভারতের বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষিতে কলকাতা আর ঢাকার সমীকরণও তখন বদলে যাবে নিশ্চিত। সম্ভ্রমের চোখেই তখন দেখবে সবাই। অঞ্চলের কবি সাহিত্যিকদের আক্ষরিক অর্থেই গুরুত্ব বেড়ে যাবে বহু গুণ। তবে কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে এর পরেও যদি সাহিত্যগত আত্মিক যোগসূত্রের দোহাই পেড়ে চিরকালীন আনুগত্যকেই অনেকে মেনে নেন তাহলে নতুন কিছু আর বলার নেই !

এমন অনুষ্ঠানের মঞ্চে উঠে উত্তরপূর্ব ভারতের কবির কবিতা বিস্মৃত হয়ে যদি কেউ কলকাতার কোনও কবির কবিতার উদ্ধৃতি সহযোগে তাঁর বক্তব্য শুরু করেন তবে বুঝতে হবে দার্ঢ্যতা আমাদের আর কখনই আসবে না। যথারীতি  আমাদের বাংলা কবিতা, উপন্যাস, ছোট গল্প ওই কলকাতার অনুসরণেই লিখিত হতে থাকবে অনন্ত ধারায়! অথচ যাঁদের আমরা প্রামাণ্য মনে করি তাঁরাও অনেকেই মার্কেটের অনুরাগী, উপজাত। বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় লিখেই নাম কামিয়েছেন। সর্বোপরি কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গের অনেক লিটল ম্যাগই মাঝেমধ্যে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন ছাপে! আমরা কী তবু আমাদের অঞ্চলে মার্কেট নিয়ে ক্লিশে কিছু ধারণায় গেঁড়ে বসে থাকবো; উত্তরপূর্ব ভারতের ভূমিপুত্র হওয়া সত্বেও সর্বদা অবচেতন মানসিকতায় কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা চালিয়ে যাবো ? ফলো করবো ওদের লিটেরারি জঁর ? কেন আমাদের  মানসিকতায়  আবহমান  ক্রিয়াশীল এমন বৈপরীত্য? আমাদের লিটল ম্যাগে উত্তরপূর্ব ভারতের সমস্যা ব্যতিরেকে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সংস্কৃতির ক্রাইসিস নিয়েই ইন্টেলেকচ্যুয়াল প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখে তুলকালাম করবো ? ইজ সাবমিশন ইন আওয়ার জিন?  
না, অতটা নিরাশাবাদী নই আমি। এখন বিশ্বায়নের যুগ। বিশ্বায়নের ভালো এবং মন্দ - দুইই আছে। এর বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন নেই এখানে। ইতিবাচকতার প্রেক্ষিতে শুধু এটুকুই বলতে পারি, বিশ্বায়নের ধাক্কায় তথাকথিত উন্নত আর অনুন্নত অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বিভাজন প্রায় অনেকটা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মেগা সিটি, উন্নত প্রদেশের মনোপলি কিম্বা একচ্ছত্র আধিপত্যের দিন শেষ। সে সংগীত, শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রই হোক কিম্বা ক্রীড়াক্ষেত্র - ছোট শহর, অনুন্নত প্রদেশ থেকেও উঠে আসছে এখন বহু প্রতিভাবান ছেলেমেয়ে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের পারফরমেন্সে মুগ্ধ হচ্ছে সবাই । বৃহৎ শিল্পসংস্থাগুলিও সহায়তার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছে। আঞ্চলিক সাহিত্যের বার্তাও ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত পৃথিবীর সর্বত্র সামাজিক গণ মাধ্যমের মারফৎ। মেগা সিটি, উন্নত প্রদেশের প্রতি তাই ছোট শহর, অনুন্নত প্রদেশের জনগণের একাংশের সাবমিশন বা সমর্পণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। এই সময়ের শরীক হিসেবেই আগামী দিনে উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় বাংলা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন নতুন পথের দিশারী হয়ে উঠবে নিশ্চিত। স্পনশরশীপের বদান্যতায় গোটা দেশেই হয়তো এমন উৎসব হয়ে উঠতে পারে অতুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর মৌলিকতায় ঋজু হবে তখন এই অঞ্চলের বাংলা সাহিত্য। এবারের সপ্তম উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় বাংলা লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন আমায় এই ভাবনাতেই ঋদ্ধ করল!

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.