Header Ads

বড়ন্তি-অমলিন সংস্কৃতিতে আজও উজ্জ্বল


অসীম দাশগুপ্ত, কোলকাতা
“দশ টাকা দিবি? বিস্কুট খাবো”, পিছনে ফিরে দেখি আট দশ বছরের একটা ছেলে। পরনে একটা ছেঁড়া নোংরা জামা আর প্যান্ট। কচি কচি তালপাতা দিয়ে একটা ফুল বানিয়েছে, তুলে ধরলো আমার দিকে। হাতে দশ টাকা দিতেই ছেলেটার চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো অনাবিল নিস্পাপ হাসি, দিনের প্রথম আলোর মতোই নির্মল। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম বড়ন্তি। হতো দরিদ্র আদিবাসী সম্প্রদায় মানুষের বাসভূমি। তথাকথিত সভ্যতার আলো এই গ্রামের মানুষের উপর এখনো প্রভাব ফেলতে পারেনি, তাই বোধহয় এদের নিজস্ব সংস্কৃতি এখনো অটুট। গ্রামের মাটির ঘর গুলো সুন্দর অল্পনায় যেন একটুকরো স্বর্গ। পরিস্কার মাটিতে নিকানো উঠানে লুটপুটি খায় সোনামাখা রোদ আর সন্ধ্যায় যখন আকাশে রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠে আর প্রকৃতির গাছপালা, নদীনালা, পথঘাট ঢেকে যায় রুপালি চাদরে, তখন মাটির কুটিরের আঙিনায় খেলে বেড়ায় রুপালি আলো। ধামসা মাদলের সুরেলা ধ্বনিতে মেতে উঠে চরাচর।
আধুনিক যুগের মানুষ আমরা,  সভ্যতা বলতে বুঝি জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি আর পুরোনো সংস্কার ও সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়ে তথাকথিত উন্নত সমাজের ধ্যান ধারণাকে আত্মস্থ করে নেওয়া। আমাদের সভ্য সমাজ তাই আজ আমাদেরই নিজস্ব সংস্কৃতিকে চিনতে চায় না। এই ভোগবাদী সমাজে আমাদের নিজস্ব সভ্যতা ব্রাত্য। আমাদের শিক্ষিত সমাজের মানুষেরা যখন যান্ত্রিক জীবনে বাঁচার রসদ খোঁজে কৃত্রিম ভোগবিলাস আর চটুল রসের আরকে, তখনই দেশের আনাচে কানাচে ছাড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই আশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত মানুষগুলো নিজেদের জীবন থেকেই খুঁজে নেয় নির্ভেজাল আনন্দ, নিজেদের মতো করেই ভালো থাকে তারা - প্রকৃতিকে ভালোবেসে, প্রকৃতির সম্পদকে রক্ষা করে। গিয়েছিলাম বড়ন্তি। একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক সমীক্ষার দায়িত্ব নিয়ে। পূর্বাঘাট পর্বতমালার ছোটো ছোটো টিলা পাহাড়ের কোলে মালভূমি অঞ্চলের একটি ছোট্ট গ্রাম। তিন পাহাড়ের মাঝে বিশাল বিস্তীর্ণ বড়ন্তি লেক।বিকালের সূর্য যখন পাহাড় সারির মাঝখানে অস্তমিত হয়, তখন এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি হয়। গ্রামটির চারিধারে গহন বনভূমি, একটা গা ছমছম করা অনুভূতি। শহুরে কোলাহল থেকে যোজন দূরে শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ। নিস্তরঙ্গ জীবন, নেই কোনো বাহ্যিক আড়ম্বর। পাহাড়ের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত বিস্তৃত ক্ষেতে সোনালী ধান ফলেছে, বড় কষ্টের সে ফসল। কারণ তীব্র জ্লসঙ্কট। একফসলি চাষে সম্বতসরের সংকুলান হয় না। জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে, শালপাতার থালা বানিয়ে, জঙ্গলের মৌচাকের মধু সংগ্রহ করে কষ্টে জীবননির্বাহ। তবু তারা হাসে, গান গায় জীবনকে উপভোগ করে। ঘরের দেয়ালে দুচারটে নামী দামী শিল্পীর  ছবি টাঙিয়ে আমাদের শিল্প রুচির যখন কৃত্রিম বড়াই করি, তখনই আবার  দেয়ালের পেরেকে ঝুলে থাকে পরনের শার্ট অথবা ড্রইংরুমে কোকোকোলার বোতলে কাগজের তৈরি ফুল সাজিয়ে আমাদের শিল্পরুচির দীনতা জাহির করি। আমাদের শিল্প রুচি বোধ কত যে মেকি। সাঁওতাল রমণীরা তাদের মাটির কুটিরে নিজের হাতে আলপানা দেয়, যত্ন করে মাটির পাত্র সাজিয়ে রাখে, নিখুঁতভাবে ধানের গোলা সাজায়। নিজেদের জীবনযাত্রার দৈনন্দিন ক্রিয়াকাকলাপেই প্রকাশ পায় তাদের রুচিবোধ।
প্রাকৃতিরানী উজাড় করে দিয়েছে বড়ন্তিকে। একদিকে বেরো পাহাড়ের অপরূপ শোভা, জয়চন্ডী পাহাড়ের মাথায় দেবীমাতা চন্ডী মন্দির যেখানে প্রায় ৪০০ সোপান ভেঙে পৌঁছানো যায়। এই পাহাড়ের মাথা থেকে সূর্যাস্ত এক না-ভোলা অভিজ্ঞতা। পনচেৎ পাহাড়ের পাদদেশে গড়পঞ্চকোট মন্দির ও রাজবংশের অতীত ইতিহাস পর্যটকদের কাছে অতীব আকর্ষণীয়। অন্যদিকে পুরুলিয়ার সবথেকে উঁচু পাহাড় বিহারিনাথ যার পায়ের কাছে দেবাদীদেব বিহারিনাথের মন্দির, শুশুনিয়া পাহাড়ের নিবিড় হাতছানি উপেক্ষা করা যায় না। বড়ন্তি, তার মানুষজন, তার পরিবেশ আর তার প্রকৃতি সবার কাছে দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কীভাবে পৌঁছাবেন: কলকাতা থেকে ট্রেন বা বাসে আসানসোল পৌঁছে যান, সেখান থেকে ভাড়া গাড়ীতে ৪৫ মিনিটে পৌঁছে যান বড়ন্তি।


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.