Header Ads

৭ম উত্তর--পূৰ্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন - গুয়াহাটি – ২০১৮



সঞ্জীব দেঃ আগরতলা
আগরতলা থেকে আমি অশোক স্যার, রাজীব, অভিক, শুভ্রশংকর, অনুপ সহ সকাল সকাল রওনা হলাম গুযাহাটি দিকে। ডিসেম্বরের ২২, ২৩ এবং ২৪ তারিখ ছিল লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন। কুমারঘাট থেকে আমাদের সাথী হলেন স্রোত-এর কর্ণধার গোবিন্দ ধর, সৃষ্টিলোক-এর গোপাল দাস, লেখিকা পদ্মশ্রী মজুমদার (বইবাড়ি), দোলনা-র সম্পাদক গৈরিকা। লিটল ম্যাগকে ভালোবেসেই আমাদের এই পথ চলা। করিমগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ালেই সামনে এসে হাজির হন মনন ভূমির সম্পাদক আ. জাহিদ রুদ্র। এর পর আবার লামডিং থেকে দু’ঘন্টা অপেক্ষা করে সোজা গুয়াহাটির ট্রেনে। লামডিং থেকে আমাদের সাথী হন সৃজনী পত্রিকার সম্পাদক মৃদুলা ভট্রাচার্য ও আদীমা মজুমদার। এর ফাঁকে সময়ে সময়ে ফোন করে খবর নিচ্ছেন আয়োজকদের অন্যতম গৌতম ভট্টাচার্য ও বাসব রায়। ২২ ডিসেম্বর সকাল ৮টা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম গুয়াহাটি স্টেশন। সবাই ট্রেন থেকে নেমে গৌতম দার কথামত দুটি গাড়ি নিয়ে চলে আসি মহানগরের ভিআইপি গেস্ট হাউস। ততক্ষণ অবধি সেখানেই গৌতম দা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সৌজন্য বিনিময়ের পর তিনিই আমাদের পূর্ব নির্ধারিত বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে যান। খুব সুন্দর থাকার ব্যবস্থা, অমায়িক পরিষেবায় আমি মুগ্ধ। এরপর স্নান সেরে ঘন্টা খানেক বিশ্রাম করে দুটি গাড়ি নিয়ে আমরা বেড়িয়ে পরি। পাথুরে কালাপাহাড়ের পাশ দিয়ে কামাখ্যা মন্দিরকে পেছনে ফেলে কুয়াশায় আচ্ছন্ন কালাপাহাড়ের বুকে গাছের ফাঁকে উঁকি মারা ছোট ছোট বাড়ি দেখতে দেখতে বিলের নিস্তব্ধতায় থমকে দাঁড়াই। আহা! সেই সৌন্দর্য রস আহরণ করে চলে আসি অ্যাকোল্যান্ড পার্কে। তারপর আমরা বিস্তৃর্ণ কালাপাহাড় প্রদক্ষিণ করে আবার রামকৃষ্ণ আশ্রমের বিপরীতে ভিআইপি গেস্ট হাউসে ফিরে আসি। এরপর ঠিক সময়মতো চলে আসে আমাদের জন্য দুপুরের খাবার। সবাই খেয়ে বিশ্ৰাম নিয়ে সাড়ে ছ’ টায় তুষার কান্তি সাহা আমাদের নিয়ে চলে যান সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। সেখানে গিয়ে মন ভরে যায়। অনেক বড় জায়গা জুড়ে সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। সম্মেলনে ঢোকার মুখেই বিশাল বড় গেট। গেট পার হয়ে আরও একটু ঢুকলেই রয়েছে চা ও জল খাবারের দারুন আয়োজন। তার অপর প্রান্তেই স্কুলের বড় মাঠ। মাঠে ঢুকতেই এক কোনে রয়েছে খাবারের আয়োজন। সম্মেলনের হল ঘরে ঢুকেই দেখি বিশাল অনুষ্ঠান। মঞ্চ ও পুরোটা হল কাপড় দিয়ে সাজানো। তিন দিকেই টেবিল চেয়ারে করে ছোট পত্ৰিকার স্টলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাঝখানে দর্শকাসন। ততক্ষণে সম্মেলনে এসে উপস্থিত হলেন ভারতের লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্ত, ড০ উষারঞ্জন ভট্টাচার্য, প্রসূন বর্মণ, বাসব রায় সহ আরও অনেকেই। উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন লিটল ম্যাগের সম্পাদকরা এক এক করে হলে ঢুকছেন। মঞ্চে চলছে স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় বিভিন্ন স্বাদের গান। কানে আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে লালন, রবি-নজরুল, সহ বিভিন্ন জনপ্রিয় লোকগান। ভেতরে ঢুকতেই প্রসূন দা বললেন রেজিস্ট্রেশন করে নিতে। এরপর আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হল দারুন একটি সম্মেলনের ব্যাগ। তার ভেতরে রয়েছে একটি কলম, তিনদিনের প্রোগ্রাম সূচী, একটি ১৬০ পৃষ্ঠার ডাইরি যার সুন্দর কভারে লেখা রয়েছে ৭ম উত্তর পূর্বাঞ্চালীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন।

এরপর প্রসূন দার কথামত আমরা যে যার টেবিল বুক করি। পেছনে টাঙ্গিয়ে রাখি যার যার ম্যাগাজিনের ফ্লেক্স। বাইরে এসে চা, পেটিস খেতে খেতে নজরে পরে হলের পাশেই বাইরের দিকে সাজানো হয়েছে চিত্র প্রদর্শনী ও লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহশালা। তোড়নে ফিতা আটকানো উদ্বোধনের অপেক্ষায়। প্রদর্শনী কক্ষে ঢুকতেই প্রথমেই রাখা আছে সই করার জন্য একটি সাদা বোর্ড। এর ফাঁকেই ঘুরে যান বাংলাদেশ হাইকমিশনার এটিএম রফিকুল হক। অন্যদিকে চলছে উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ছোট পত্রিকার সম্পাদকদের রেজিস্ট্রেশন পর্ব। টেবিল নির্ধারণ, জলযোগ আড্ডা ও মঞ্চে স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গীত সন্ধ্যা। এইভাবেই প্রথম দিনের পর্ব শেষ করে রাত ন’টায় আমরা চলে যাই ভিআইপি হোটেলে যেখানেই সব প্রতিনিধিদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন দক্ষ আয়োজক মণ্ডল। আমাদের নির্ধারিত কক্ষছিল ৬২৫। সেখানেই রাত দশটায় টেবিলে খাবার পৌঁছে দেন। খাওয়া শেষে রুমে যান অধ্যাপক সুশান্ত কর দাদা। এরপর আদিমা দির ঘরে ক্ষণিক আড্ডা শেষে সেদিন রাত ১ টায় আমরা ঘুমোতে গেলাম।

পরদিন ফের সকালে হোটেলে জল খাবার সেড়ে ১১ টা নাগাদ চলে যাই সম্মেলন প্ৰাঙ্গণে। গৌতম দা, তুষার দা সহ আমরা সবাই। স্কুল প্ৰাঙ্গণের তিনদিকেই সাজানো রয়েছে উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন  স্থানের প্রায় ৪৫ টি লিটল ম্যাগ স্টল। ত্রিপুরা থেকে উপস্থিত হয়েছেন -- দিলীপ দাস(ভাষা সাহিত্য), দেবব্রত দেব (মুখাবয়ব), গোবিন্দ ধর (স্রোত), সম্মেলনের সর্ব কনিষ্ঠ সম্পাদিকা গৈরিকা ধর (দোলনা), কুসুম পদ্মশ্রী মজুমদার, সঞ্জীব দে (বিজয়া), নকুল রায় (স্বতন্ত্র মেধা), শুভব্রত দেব(অক্ষর), জহর দেবনাথ (প্রবাহ), সুমিতা ধর বসু ঠাকুর (আকাশের ছাদ), জ্যোতির্ময় রায়( প্রজন্ম চত্বর), সন্তোষ রায়ের ( জলজ), খোকন সাহা (ফোটামাটি), অভীক কুমার দে (সমভূমি ), রাজীব মজুমদারের (রূপান্তর ), নবীন কিশোর রায় (সময় সংকেত), প্রভৃতি কাগজ এবং অন্যান্য  রাজ্য থেকে দেবযানী ভট্রাচার্য (বরাক নন্দিনী), পৃথ্বীরাজ পুরকায়স্থ (যাযাবর), সমীর চক্রবৰ্তীর (মানস দর্পন), শিপ্রা চৌধিরী (কর্মশালা), ভানুভূষণ দাস (উজান), অপর্ণা দেব (সেবা), প্রাণকৃষ্ণ কর (অবগাহণ), ড.তিমির দে (জলসিঁড়ি), সংলাপ, পূর্বাদ্রী, আজিদ রুদ্র (মননভূমি়), দিলীপ কান্তি লস্কর (লালন মঞ্চ), একা এবং কয়েকজন, উত্তরণ, কবিতা এখন, বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন, বিষয় ভিত্তিক বাংলা প্রবন্ধের কাগজ, অনুপ দেবনাথ( মুহূরী), শর্মিলা দত্ত (মানবী ), মৃদুলা ভট্টাচার্য(সৃজনী), অমল গুপ্ত সম্পাদিত ‘নয়া ঠাহর’ প্রভৃতি কাগজ।
অলকানন্দার গানে শুরু হয় দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান 
উদ্বোধনী মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন - অনিমা গুহ, সন্দীপ দত্ত, একা এবং কয়েকজন পত্রিকার সম্পাদক উদয়ন বিশ্বাস, নিরুপমা বরগোহাই, তোষপ্রভা, ঊষারঞ্জন স্যার প্রমুখ। স্বাগত ভাষণ রাখেন সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জয় গুপ্ত। প্রথম অধিবেশনের চতুর্থ বক্তা ছিলেন অনিমা ম্যাম, ঠিক তখনেই হলে প্রবেশ করেন বরেণ্য অধ্যাপক রামকুমার মুখোপাধ্যায়। মঞ্চে উপস্থিত অতিথিদের সম্মিলিত প্রদীপ প্রজ্জ্বোলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। আয়োজকদের পক্ষ থেকে অতিথিদের বরণ করে নেন - চিত্তরঞ্জন দাস, সুস্মিতা মজুমদার, বাসব রায়, সঞ্জয় গুপ্ত প্রমুখ। বক্তাদের সমৃদ্ধ আলোচনায় শেষ হয় প্রথম পর্ব।
এরপর দুপুর ২টোয় শুরু হয় লিটল ম্যাগ সম্পাদকদের দ্বারা "এই সময় ও লিটল ম্যাগাজিন " শীৰ্ষক আলোচনা চক্ৰ। লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্তের সভাপতিত্বে আলোচনা করেন -- ত্রিপুরা থেকে আরশি নগরের সম্পাদক সুভাস দাস, শিলচর থেকে সুজিত দাস, বাংলার অধ্যাপক প্রাণকৃষ্ণ কর, লামডিং থেকে অঞ্জলী রায়, অসমিয়া গল্পকার সঞ্জীব ডেকা প্রমুখ। সভাপতির আলোচনার পর উদয়ন বিশ্বাস সম্মান স্মারক তুলে দেন পরমানন্দ মজুমদারের হাতে।
এরপর তৃতীয় পর্বে শুরু হয় বাসব রায়ের সঞ্চালনায় গ্রন্থ ও পত্র পত্রিকা উন্মোচন ও কবিতা পাঠ। কবিতা পাঠ করেন - প্রবুদ্ধ সুন্দর, সুমিতা ধর বসু ঠাকুর, আরুদ্র, খোকন সাহা, সঞ্জীব দে, রাজীব মজুমদার, গোবিন্দ ধর, আদীমা মজুমদার, মৃদুলা ভট্টাচার্য, প্রমুখ। এর পর শুরু হয়  রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে গল্প পাঠের আসর। গল্প পাঠ করেন দেবব্রত দেব, মৃদুলা ভট্টাচার্য, পদ্মশ্রী মজুমদার, আদীমা মজুমদার, শর্মিলা দত্ত, গৌতম ভট্টাচার্য, দেবীপ্রসাদ বাবু সহ আরও অনেকেই। গল্পপাঠ শেষেই বিশেষ সম্মান পর্ব --এই পর্বে সম্মান গ্রহণ করেন কবি নকুল রায়, কবি দিলীপ দাস, কবি ধনঞ্জয় চক্রবর্তী। যাঁদের হাতে এই সম্মান তুলে দেন তিনি হলেন ত্রিপুরার বিশিষ্ট লেখক শঙ্খশুভ্র দেববর্মন। ২৩ ডিসেম্বর দিনের শেষ পর্বে গানে গানে সুরের মুর্ছনায় ভরে ওঠে গোটা লিগটল ম্যাগ চত্ত্বর। মুড়ির মোয়া, নারকোলের নাড়ু, পিঠে, পুলি, বিস্কুট ও চায়ের কাপে চুমু দিতে দিতে গান শোনার অনির্বচনীয় আনন্দের ফোয়ারা ঝরছিল চারপাশে। এরপর রাত ন’ টা নাগাদ ফের সুশৃঙ্খল আয়োজনে খাওয়া দাওয়া সেরে হোটেলে জমানো আড্ডা, গানের পর অবশেষে ক্লান্তিতে ঘুমাতে যাওয়া।

২৪ ডিসেম্বর দশ টায় ফের অনুষ্ঠান শুরু হয় সম্পাদকীয় আড্ডার মাধ্যমে। আড্ডা শেষে শুরু হয় সাউথ পয়েন্ট স্কুলের অনুষ্ঠান। কচিকাঁচাদের পরিবেশন আমার মনকে দারুণভাবে স্পর্শ করেছে। গনেশ বন্দনা, আবৃত্তি আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে। এই অনুষ্ঠানের শেষে শুরু হয় গৌতম ভট্টাচার্যের সঞ্চালনা ও সন্দীপ দত্তের সভাপতিত্বে সম্মেলনে প্রাপ্তি - অপ্রাপ্তি নিয়ে মতামত সভা। মত ব্যক্ত করেন -- কবি ও গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধন, অধ্যাপক সুশান্ত কর, জহর দেবনাথ, অপর্ণা দেব, সম্মেলনের সর্বকনিষ্ঠ সম্পাদক আট বছরের গৈরিকা ধর এবং বয়োজ্যেষ্ঠ সম্পাদক আশি বছরের নারায়ণ সরকার। এই পর্বের শেষে বাসব রায়ের পরিচালনায় এবং সমরজিত সিনহার সভাপতিত্বে শুরু হয় কবিতা পাঠের আসর। কবিতা পাঠ করেন-- সুজয় রায়, অর্জুন দাস, অভিজিত চক্রবর্তী, অভীককুমার দে, খোকন সাহা, তাপস পাল, নবীন কিশোর রায়, নকুল রায়, দেবলীনা সেনগুপ্ত, বাসব রায়, গোবিন্দ ধর সহ আরও অনেকেই। এর পর অধ্যাপক সুশান্ত কর ও প্রসূন বর্মণের পরিচালনায় শুরু হয় প্রতিনিধি আলোচনা। অংশ নেন - হোসেন, জ্যোতির্ময় পুরকায়স্থ, দেবব্রত দেব, শর্মিলা দত্ত, খোকন সাহা, রাজীব মজুমদার সহ আরও অনেকেই। এরই ফাঁকে সম্মেলনের সভাপতি ড০ ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য ও প্রধান অতিথি রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে মঞ্চে ডেকে নেন বাংলাদেশের হাই কমিশনার এটিএম রফিকুল হক সাহেবকে। আয়োজকদের তরফ থেকে তাঁকে বিশেষ সম্মান জানানো হয়। সবশেষে মনোজ্ঞ সঙ্গীতানুষ্ঠান উপভোগ করার মতো ছিল।
পরিশেষে বলবো তিনসুকিয়ার পর প্রতিকুল পরিবেশে দাঁড়িয়েও এমন একটি সাহসী অনুষ্ঠান করে দেখালেন গুয়াহাটির আয়োজকরা, তার জন্য শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছাড়া আর কি আছে দেওয়ার! বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি, সমাজ, গুয়াহাটি আয়োজিত ৭ম উত্তরপূর্ব লিটল ম্যাগাজিন উৎসব আয়োজকদের সুশৃঙ্খল ও আন্তরিক আয়োজন সার্থক রূপ নিয়েছে। আসছে বছর শিলচরের আয়োজনের সার্থকতার দিকে চেয়ে এখানেই ইতি টানছি। সবাই ভাল এবং সুস্থ থাকবেন নমস্কার।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.