Header Ads

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ভারতবর্ষ

  • দেবপ্রসাদ রায়, প্ৰাক্তন সাংসদ

ভারতবর্ষের সাথে ইসলামের সম্পর্কের সূত্রপাত ‘আক্রমণ’ দিয়ে না ‘আমন্ত্রণ’ দিয়ে ? ইতিহাস বলছে আমন্ত্রণ দিয়ে । বাগদাদের সুলতান হারুন অল রসিদ রোগগ্রস্ত হলে যখন ইউনানী চিকিৎসায় তার কোন অবস্থার উন্নতি ঘটেনি, তখন ভারত থেকে ‘মাণিক্য’ নামে এক প্রখ্যাত আয়ুর্বেদ চিকিৎসককে আমন্ত্রণ জানানো হয়, এবং তার চিকিৎসায় হারুন অল রসিদ সুস্থ হয়ে ওঠেন ।
তারপর থেকে আরব দুনিয়ায় আয়ুর্বেদ চিকিৎসা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং একের পর এক চিকিৎসককে বাগদাদে আমন্ত্রণ জানানো হতে থাকে শেষ পর্যন্ত খলিফা মুয়াইয়ার সময়ে সিরিয়া ও খাসগারে ভারতীয় চিকিৎসক ও রাজ কর্মচারীদের কলোনিও গড়ে ওঠে ।
৭১২ সালে পাঞ্জাব ও সিন্ধু যদিও মহম্মদ বিন কাসিমের দ্বারা আক্রান্ত হয়; ইসলাম এ দেশে প্রবেশ করেছে অন্য পথে । উত্তর কেরালার কোডুঙ্গালুরে মালিক বিন দিনারের নেতৃত্বে ইসলামে বিশ্বাসী যে আরবকূল এসে বসবাস শুরু করেন রাস্ট্রকূট বংশের রাজারা তাদের শুধু সাদরে গ্রহণ করেননি, ধর্ম প্রচার করার অবাধ অধিকার দিতেও কার্পণ্য দেখান নি । ভারতীয় রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় তাই প্রথম মসজিদ গড়ে ওঠে দক্ষিণ ভারতে ।

‘সহাবস্থান’ যে ‘সংঘাতের’ চেয়ে অনেক বেশী প্রভাব বিস্তারকারী তার প্রমাণ, সুলতান মহমুদ যেখান দিয়ে ১০২৪ সাল থেকে ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেছে, সেই উত্তর-পশ্চিম ভারতে (রাজস্থানে) মুসলমানের উপস্থিতি মাত্র ৬ শতাংশ, আর দক্ষিণ ভারতে কেরালায়, যেখানে ইসলাম এসেছে আরব বণিকদের হাত ধরে, সেখানে মুসলমানদের উপস্থিতি ২১ শতাংশ ।

উত্তর ভারতে বার বার মুসলিম আক্রমণ হয়েছে, সুলতানি শাসন কায়েম হয়েছে, হিন্দুরা আক্রান্ত হয়েছে, তবুও সামাজিক স্তরে হিন্দু ধর্ম ও ইসলামকে পরস্পরের কাছাকাছি করার প্রয়াস কখনো থেমে থাকেনি । রামানন্দ, তূকারাম, কবির, নানক প্রমুখ উদারপন্থী । ধর্মপ্রচারকেরা তাদের দর্শনের মাধ্যমে বার বার এটাই বলতে চেয়েছেন, হিন্দু ধর্ম ও ইসলামের আবেদনে কোন মৌলিক তফাৎ নেই । তাই শাসন কর্তারা কখনও কখনও সংঘাতের পথ নিলেও সামাজিক স্তরে দুই ধর্মের উপর একটা সমন্বয় সাধনের স্রোত বরাবরই প্রবাহিত হয়েছে ।
প্রচলিত ইতিহাসে সংঘাতের চেহারাও তুলে ধরার ক্ষেত্রে সবসময় ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করা হয়নি । হলদিঘাটের যুদ্ধে রাণা প্রতাপ আকবরের কাছে পরাস্ত হন বলে আমরা সবাই জেনেছি । কিন্ত আকবরকে সেই যুদ্ধে জয়লাভ করতে রাণা প্রতাপের বিশ্বস্ত সেনাপতি হাকিম শুরের মৃত দেহের উপর দিয়ে প্রবেশ করতে হয়েছিল, ইতিহাস এই তথ্যটা আমাদের জানাবার আগ্রহ দেখায়নি

ছত্রপতি শিবাজিকে আফজল খাঁ হত্যা করতে চেয়েছিলেন, আমরা ইতিহাসে পড়েছি, কিন্ত শিবাজীর প্রধানমন্ত্রী হায়দার আলি তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত পার্শ্বচর ছিলেন, তা জানাতে প্রচলিত ইতিহাস কখনও সোচ্চার হয়নি ।
বাবর মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ বানিয়েছিলেন বলে একটা বিতর্কিত বিষয় আমাদের জানানো হয়েছে, কিন্ত হনুমান ঘড়ি কোনো সময়ে মসজিদ ছিল, এই অভিযোগে মুসলমানরা হনুমান ঘড়ি আক্রমণ করলে অযোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ তা প্রতিহত করেছিলেন এ তথ্য ইতিহাস আমাদের জানাতে কার্পণ্য করেছে । ঔরঙ্গজেব ‘ধর্মান্ধ’ ছিলেন আমরা সবাই জানি । তার হিন্দু বিরোধী আচরণের অনেক বর্ণনাও আমরা পাই । কিন্ত একটি বিষয় জানানো এক্ষেত্রে আমার কর্তব্য । প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ইতিহাস রচয়িতা শ্রী বিশম্ভর নাথ পাণ্ডে যখন এলাহাবাদের মেয়র ছিলেন, তখন তিনি পুরনো কাগজ-পত্র বাছতে গিয়ে একটি ফারসী ভাষায় লেখা ফরমান পান । তিনি নিজে ফারসী জানতেন না বলে, সে ভাষায় পণ্ডিত তেগ বাহাদুর সপ্‌রুর কাছে ফরমানটি নিয়ে যান । তেগ বাহাদুর সাহেব ফরমানটি পাঠোদ্ধার করে শ্রী পাণ্ডেকে জানান যে এইটি ঔরঙ্গজেবের ফরমান । এতে খাণ্ডোয়ার ওঙ্কারেশ্বর সহ ছটি শিবমন্দিরকে ভূমি দানের আদেশ দেওয়া হয়েছে । এই অন্য ঔরঙ্গজেবের সাথে আমাদের প্রজন্ম পরিচিত হওয়ার কোন সুযোগ পেল না ।
মোগল শাসনের অবসানে ব্রিটিশ শাসন এসেছে, কিন্ত খ্রিষ্ট ধর্ম এসেছে তারও অনেক আগে । যিশু খ্রীস্টের প্রত্যক্ষ শিষ্য সেণ্ট টমাস দক্ষিণ ভারতে ২০ বছর ধরে খ্রীস্ট ধর্ম প্রচার করে ৫৮ সালে কোচিনে দেহত্যাগ করেন । সেখানে আজও তার সমাধি অটুট আছে ।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি রাজ দণ্ড হাতে তুলে নেয়, আর ১৭৬৯ সালে তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে উত্তরবঙ্গে । ভবানী পাঠক ও মজনু শাহের যৌথ নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ বলে খ্যাত । এই আন্দোলন হিন্দু ও মুসলমানকে একযোগে রণাঙ্গণে নিয়ে আসে ও ১৮০০ সাল পর্যন্ত এ লড়াই অব্যাহত থাকে । লেনন, ম্যাকেঞ্জি ও রেনান- তিন বৃটিশ সেনাধ্যক্ষ এই বিদ্রোহে প্রাণ বিসর্জন দেয় এবং অভিভক্ত বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই বিদ্রোহের প্রভাব পড়ে । ইতিহাসবিদদের বক্তব্য, সামাজিক স্তরে ‘সুফিজিম’ এর প্রভাব এত গভীর ছিল যে, ধর্মের বাধা নিষেধকে উপেক্ষা করে এই আন্দোলনে হিন্দু ও মুসলমান একত্রিত হতে কোন ইতঃস্তত বোধ করেনি ।
ওয়াহবী আন্দোলন স্বাধীনতার যুদ্ধের আরেকটি স্বল্পোচ্চারিত অধ্যায় । ১৮২২ সাল থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত মৌলানা ও মৌলবিদের দ্বারা পরিচালিত এই আন্দোলন সৈন্য শিবিরগুলিতে গোপনে যে বীজ বপন করেছিল, বিশেষতঃ উত্তর ভারতের মালদা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত, তার ফলশ্রুতিতে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ জন্ম নেয় । আরও আগে ১৮৩২ সালে নারকেলবেড়িয়ার তিতুমীর নামে যে মানুষটি বাঁশের কেল্লা বানিয়ে তিন দিন প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তার পর প্রাণ বিসর্জন দেয়, সেও ওয়াহবী আন্দোলনের ফসল । তাঁর প্রকৃ্ত নাম যে মির নিশার আলি-এ তথ্য ইতিহাস জানাতে আগ্রহ দেখায়নি ।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের তিনটি পর্বে তিনজন ব্যক্তিকে পাওয়া যায়, যারা তিনজনই ছিলেন মুসলমান৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্বে বাহাদুর শাহ জাফর । স্বাধীনতার সংগ্রামে প্রথম দ্বীপান্তর, মৌলবী আলাউদ্দিন । স্বাধীনতার পর প্রথম পাক-ভারত যুদ্ধে জম্মুর নৌসেরার প্রাঙ্গণে প্রথম শহীদ ব্রিগেডিয়ার ওসমান ।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস তাই প্রমাণ করে এ দেশে সর্বধর্মের লোক প্রাণ বিসর্জনের ভেতর দিয়ে, বলিদানের ভেতর দিয়ে এ দেশের মূলস্রোতে নিজের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করেছে । তাই কাউকেই মূল স্রোতের বাইরে রাখবার কোন বিশেষ অধিকার কারোর নেই । ইসলাম নিশ্চয়ই বাইরে থেকে এসেছেকিন্ত মুসলমান এ দেশেই জন্মেছে । ১৯৫৫ সালে সংসদে এক বিতর্কের উত্তরে পণ্ডিত জহর লাল নেহেরু বলেছিলেন “Christianity in India is as old as the religion itself….”

ভারতবর্ষে একবার থাইল্যাণ্ডের রাষ্ট্রপ্রধান এসেছিলেন তার পবিত্র তীর্থস্থান বোধগয়াতে । বিহারের রাজ্যপাল পাটনা থেকে তার সঙ্গে ছিলেন । তিনি বোধগয়া পরিদর্শন করে রাজ্যপাল সফি কুরাশীকে বলেন – “এটা সত্যি আশ্চর্য্যের ! যে দেশে বৌদ্ধ ধর্ম জন্মেছে আজ সেখানে তা প্রায় বিলীন, আর আমরা দক্ষিণ এশিয়ার কোটি কোটি লোক এই ধর্মকে আঁকড়ে রেখেছি ।” উত্তরে সফি কুরেশী বলেছিলেন, ‘ধর্ম আমাদের কাছে সূর্যের মতো । যখন পশ্চিম দিকে অস্ত যায় তখন পূর্ব দিকে উদিত হয় । আজ বৌদ্ধ ধর্ম আমাদের দেশে অস্ত গেছে বলেই তোমার দেশে উদিত হয়েছে ।’ আমার দেশের বৌদ্ধ ধর্ম যদি দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ধর্ম হতে পারে, তবে ইসলাম বাইরের থেকে এলেও আমার দেশের মানুষের নিজের ধর্ম হিসাবে নিশ্চয় স্বীকৃ্তি পাওয়ার দাবী রাখে । তাই যখন গোধরার অছিলায়, নারোরা পাটিয়া, বেস্ট বেকারী বা বিলকিস মামলার মত শাসনযন্ত্রের প্রশ্রয়ে সংখ্যালঘুদের নিধন যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় তখন দেশের গণতন্ত্রে মূল ভিতটাই নড়ে ওঠে

সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হিন্দু ভাবাবেগকে উস্‌কে দিতে নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে । বলা হচ্ছে ‘গর্ব সে কহো হাম হিন্দু হ্যায় ।’ দেশের ৮৩ শতাংশ হওয়ার পরও তোমাকে বার বার জানাতে হবে কেন, তুমি কে ? যাঁকে জানাতে চাইছো, NSSO- সার্ভে বলছে তাঁরা সংখ্যালঘুরা – শিক্ষায়, ভূমি মালিকানার ক্ষেত্রে, বেকারত্বের হারের ক্ষেত্রে সব বিষয়ই সংখ্যাগরিষ্ঠের চেয়ে পিছিয়ে । তাকে বার বার ভয় দেখিয়ে কি লাভ হচ্ছে ? যত তাদের ভয় দেখানো হবে, ততই তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে আর হয়তো কখনো কখনো নিরাপত্তার প্রয়োজনে দেশের বাইরে তাকাতে চাইবে ।

তবুও তালিবানি শাসনের অবসানে, আফগানিস্থানে যত আল-কায়দার জঙ্গী ধরা পড়েছে, তাঁতে আফগান আছে, চেচেন আছে, উজবেক আছে, ফিলিপিনো আছে, কিন্ত একজন ভারতীয়কেও পাওয়া যায়নি বরং সেনাবাহিনী থেকে তারিফকে যখন নিখোঁজ বলে প্রায় অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, তখন সে পাকিস্থানের জেল থেকে বাড়ি ফিরে আসে, প্রমাণ করে, সে পালায়নি, দেশের জন্য বিদেশের কারাগারে পড়ে থেকেছে ।
এদেশের দূর্ভাগ্য, যে গৈরিক রং যুগে যুগে ত্যাগের প্রতীক হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে, আজ তা, মৌলবাদের প্রতীক হিসাবে পরিণত হয়েছে । তাই সাম্প্রতিককালের ‘তেরঙ্গা যাত্রার’ পতাকার তিন রং প্রতিকী চেহারা নিয়ে থেকে গেছে, পরিধানের ‘গৈরিক’ রং মুখ্য হয়ে উঠেছে ।

যে দেশে হলদিবাড়ীর হুজুর সাহেবের মত অসংখ্য মাজারে প্রতি উৎসবে হিন্দু-মুসলমান একত্রিত হয়, রাজগঞ্জে রফি-বাপীরা একত্রে পূজোর আয়োজন করে, সে দেশে মৌলবাদ কখনো শেষ কথা বলতে পারে না
বরং তাদের দিকে তাকিয়ে কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয় :

“ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে ।
নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর ।
শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো,
শাস্ত্র মানে না, মানে মানুষের ভালো ।

বিধর্ম বলি মারে পর ধর্মেরে,
নিজ ধর্মের অপমান করি ফেরে,
পিতার নামেতে হানে তাঁর সন্তানে,
আচার লইয়া বিচার নাহিকো জানে,
পূজাগৃহে তোলে রক্তমাখানো ধ্বজা –
দেবতার নামে এ যে শয়তান ভজা ।”
--------------------------------- X ---------------------------------


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.