Header Ads

এনআরসি নিয়ে বিজেপির বিভেদকামী এজেন্ডাকে পরাস্ত করার আহ্বান দীপাঙ্কর ভট্টাচার্যর


আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির(NRC) খসড়া প্রকাশ, যা ৩০ জুন হওয়ার কথা ছিল কিন্তু কার্যত এক মাস বাদে হল, অনেকগুলি গোলমেলে প্রশ্ন সামনে এনেছে। খসড়া NRC তে বাদ পড়া আবেদকের সংখ্যা বিপুল। চল্লিশ লক্ষেরও বেশী। ৩ কোটি ২৯ লক্ষ লোক এনআরসি তে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্যে আবেদন করেছিলেন , তার মধ্যে ২ কোটি ৮৯ লক্ষ তালিকায় স্থান পেয়েছেন। ৪০ লক্ষ ৭ হাজার লোক তালিকায় স্থান পান নি। কেন্দ্র আর রাজ্য সরকার আমাদেরকে এ-কথা বোঝাতেই ব্যস্ত যে এটা তো খসড়া তালিকা মাত্র এবং আপত্তি জানানোর ও ভুল সংশোধনের সুযোগ থাকছে, খসড়া NRCর ভিত্তিতে এখনই তো আর কাউকে দেশছাড়া করা বা ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হচ্ছেনা। আপত্তি জানানো ও প্রমান দাখিলের জন্যে অবশ্য এক মাস মাত্র সময়ই দেয়া হয়েছে (৩০ অগাস্ট থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর) এবং সরকার চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশের চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮। এত পড়িমরি দ্রুততায় আমলাতান্ত্রিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে ভুল সংশোধনের নিতান্ত ক্ষীণ সম্ভাবনার আর বিদ্যমান ডিটেনশন ক্যাম্পগুলির বিভীষিকার পরিস্থিতিতে চল্লিশ লক্ষ বাদ পড়া মানুষকে গ্রাস করছে যে ভীতি তা এতটাই বাস্তব যে তাকে শুধু অসার স্তোকবাক্য আর আবেদন নিবেদন দিয়েই প্রশমিত করে ফেলা যায়না। NRC আপডেট করার বর্তমান প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে আলোচনা আসামের পূর্বতন কংগ্রেস সরকার শুরু করেছিল আসাম চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি পদক্ষেপ হিসেবে, যে চুক্তি 'বিদেশী' বা বেআইনি ইমিগ্রেন্ট নির্ধারণ করার "কাট অফ পয়েন্ট" ঘোষণা করেছিল ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চকে। ১৯৫১র NRC ও তৎপরবর্তি ১৯৭১ পর্যন্ত ভোটার লিস্টকে হালনাগাদ নাগরিকপঞ্জিতে অন্তর্ভুক্তির মূল ভিত্তি (লেগ্যাসি ডেটা) বানানো হয়েছে। হামেশাই যে বহু মানুষকে বাদ দিয়ে ভোটার লিস্ট তৈরী হয়ে থাকে সে অভিজ্ঞতা স্মরণে রাখলে একথা সহজেই পরিস্কার হয়ে যায় যে NRCর বর্তমান কাঠামোটিতেই বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া অন্তর্নিহিত আছে। ১৯৫১র পর যে সমস্ত পরিবর্তন ঘটে গেছে সেগুলোর কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে -- পূর্বতন রাজ্যটি বেশ কয়েকটি নতুন রাজ্যে টুকরো হয়ে গিয়ে পুনরায় আঁকা হয়েছে আসামের মানচিত্র আর এই বিগত বছরগুলি জুড়ে চলেছে আভ্যন্তরীন পরিযান (ইন্টারনাল মাইগ্রেশন)। এর সাথে যোগ করুন সমাজের দুর্বলতর অংশ ও নিপীড়িত জনতার প্রমাণপত্রাদি না থাকার সাধারণ বিষয়টি-- NRC হয়ে যাবে বহু মানুষেরই কাছে এক দু:স্বপ্ন। বিবাহের পথ বেয়ে আসামে পরিযায়ি হওয়া গ্রামীন মেয়েরা তো নিজেদের দাবিকে যথাযথ প্রমাণ করতে বিশেষ অসুবিধায় পড়েছেন। কেননা NRC পঞ্চায়েতের দেওয়া সার্টিফিকেটকেও মান্যতা দেয়নি। NRCর ভিত্তিতে অনেক পরিবার বিভাজিত, কারও নাম আছে কারও নাই। এমনকি এরকমও অনেক আছে যাদের ভারতীয় পাসপোর্ট ও অন্যান্য পরিচিতি-নথি থাকা সত্বেও বর্তমান খসড়া NRC থেকে বাদ পড়েছেন। আসামের বহু মানুষকে আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তার গাড্ডায় কেবল মাত্র NRC ই ফেলেছে এমনও নয়। গত দুই দশক ধরে আসামের কিছু মানুষকে চিহ্নিত করা হয়েছে ডি(ডি ফর ডাউটফুল)-ভোটার হিসেবে, সাধারণত বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স দ্বারা তাদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য লেখার কারনে। এদের মধ্যে কয়েক হাজারকে আসামের কয়েকটি জেলখানার ভেতরে ডিটেনশন ক্যাম্পে ভরে রাখা হয়েছে। তাদের কেবল ভোটাধিকারই কেড়ে নেয়া হয়েছে তা নয়, কার্যত প্রায় সমস্ত  মানবিক অধিকারই হরণ করা হয়েছে। একদিকে সরকার বলছে যে বাদ পড়াদের ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হবেনা, অন্যদিকে খবরে প্রকাশ যে মোদি সরকার ৪৬ কোটি টাকা স্যাংশন করেছে নতুন ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরী করার জন্য যার মধ্যে গোয়ালপাড়ায় ৩,০০০ এরও বেশী বন্দীধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যাম্পটিও আছে। এইসব আটক রাখা ডি-ভোটারদের আর্তরব জাতীয় মিডিয়ায় বা এমনকি আসামের ভেতরেও তেমন মনযোগ পায়নি। কিন্তু ক্যাম্পগুলির বিভীষিকার গল্প এখন আর চেপে রাখা বা অস্বীকার করা যাচ্ছেনা। আসামের বাদ পড়া চল্লিশ লক্ষ মানুষের জন্যও কি এখন এই ভবিতব্যই অপেক্ষা করে আছে? এই মুহুর্তে আসামে NRCর ওপর চর্চা আবর্তিত হচ্ছে মূলত তালিকায় নাম না থাকা ও অসঙ্গতি ও চূড়ান্ত তালিকায় সেসবের সংশোধন ও অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া ও সম্ভাবনার প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু একথা এখন খুবই পরিস্কার যে আসাম ও ভারতকে অচিরেই এই শত সহস্র 'রাষ্ট্রহীন' মানুষের এক সুবিশাল সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। এবং এই বিষয়টির ওপর জনতার মাঝে এখনও কোও বিচারবিতর্ক নাই। বিজেপি আসামে বিপজ্জনক খেল শুরু করেছে। পাসপোর্ট বিধিবদ্ধকরনের নিয়ম পাল্টে ফেলে এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সামনে এনে তারা কার্যত আসাম চুক্তিকেই নাকচ করছে এবং একথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে দিয়েছে যে তারা নাগরিকত্ব ও পরিযান সংক্রান্ত প্রশ্নগুলিকে সাম্প্রদায়িক ভাবধারার ভিত্তিতে ফয়সালা করতে চায় যেখানে মুসলমানদের বহিস্কার করা হবে ও তাদের প্রতি বিরূপ প্রতিকুল আচরণ করা হবে। আসাম ও ত্রিপুরা এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ জানিয়েছে। খসড়া NRC প্রকাশিত হওয়ার পর এখন বিজেপি জনমানসে এই ধারণা তৈরী করতে চাইছে যে তারা আসাম চুক্তি কার্যকর করা এবং আসাম থেকে বিদেশী নাগরিকদের চিহ্নিত করা ও ফেরৎ পাঠানোর লক্ষ্যে বদ্ধপরিকর। কিন্তু আসাম এই প্রক্রিয়ায় যা পেল তা এক বিস্ফোরক পরিস্থিতি যেখানে দশক দশক ধরে রাজ্যে বসবাস করা চল্লিশ লক্ষ মানুষকে দায়ি করে রাষ্ট্রবিহীন ঘোষণা করা হল। এই চল্লিশ লাখ মানুষ কারা? আমরা এখনও পর্যাপ্ত তথ্য পাইনি যা দিয়ে বোঝা যাবে তাদের সামাজিক অবস্থার পরিচিতি, কিন্তু প্রাথমিক ইঙ্গিত থেকে জানা যায় যে এর অধিকাংশই মহিলা এবং বাংলাভাষী। যা স্বাভাবিকভাবেই ভারতজুড়ে, বিশেষত পার্শ্ববর্তী ওয়েস্ট বেঙ্গলে(বর্তমানে যার নতুন নাম প্রস্তাবিত হয়েছে 'বাংলা') বাঙালি সম্প্রদায়কে আলোড়িত করেছে এবং বিজেপি ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে। বাংলার বিজেপি নেতারা এখন এই রাজ্যেও NRC লাগু করার কথা বলছে, স্পষ্টতই মুসলমান সম্প্রদায়কে  টার্গেট করে যাদেরকে বিজেপি ও আরএসএস বরাবর 'বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী' সম্প্রদায় হিসেবেই তকমা দিয়ে এসেছে। 'গৌ-রক্ষা' ও 'লাভ জিহাদ'-এর পর এবার আপনি পাচ্ছেন আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে আরএসএস-বিজেপির আরেক সাম্প্রদায়িক গ্র্যান্ড গেম-প্ল্যান। জনবিন্যাস সম্পর্কিত উদ্বেগ ও উন্নয়নমুখী আকাঙ্খা থেকে অহমিয়া জনগণের আসাম আন্দোলন উৎসারিত হয়েছিল। বিজেপি চায় আসামকে ঘৃণা, প্রতারণা এবং 'বিভেদ ও শাসন' রাজনীতির ল্যাবরেটরিতে পর্যবসিত করতে। আসাম চেয়েছে সামনের দিকে এগোতে আর বিজেপি লেগে পড়েছে আসাম ও ভারতকে দেশভাগের আতঙ্ক ও অস্থিরতায় নিয়ে ফেলতে। আমাদের অবশ্যই এই বিভেদকামী ষড়যন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান ও পরাস্ত করতে হবে। বিজেপির ওই যথার্থ ও সঠিক NRC তৈরী করার অন্ত:সারশূন্য বুলিতে হবেনা, NRCর জন্য আমাদের চাই ব্যাপকতর ও সার্বিক গ্রহণেচ্ছা (ইনক্লুসিভ) ভিত্তিক কাঠামো। এবং NRC থেকে বাদ যাওয়ার সম্ভাবনাকে ন্যুনতম করার সাথে সাথে সরকারকে অবশ্যই বাদ পড়া মানুষদের জন্য সুস্পষ্ট পথ-পরিকল্প নিয়ে হাজির হতে হবে। ডিটেনশন ক্যাম্পগুলির বিভীষিকা শেষ করতে হবে। NRC তে বাদ পড়া প্রত্যেকটি মানুষের মর্যাদা ও মানবাধিকারকে আমাদের অবশ্যই উর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। যে সময়ে সারা বিশ্ব রোহিঙ্গ্যা সংকটের অন্ত ঘটাতে চাইছে তখন NRCর নামে আমরা আরো একটি মানবতা সংকট সামাজিক সংকট সৃষ্টি করতে পারিনা। ভারত অতীতে তিব্বতী ও অন্যান্য শরণার্থীদের আশ্রয় ও মর্যাদা দিয়েছে, আমরা আমাদের নিজেদেরই মানুষজনকে তাঁদের নিজেদেরই বাসভূমিতে বহিরাগত বানিয়ে অসদাচরণ করতে পারিনা।

~(৩০ জুলাই ২০১৮ আসামে NRC খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পরদিন সিপিআই এমএল লিবারেশনের কেন্দ্রীয় বিবৃতি। কেন্দ্রীয় মুখপত্র 'এম এল আপডেট'-এর সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত।)■■

1 টি মন্তব্য:

  1. এখন অব্দি সব‌ই ঠিক আছে ধরে নিলাম। আমার শৈশব কেটেছে কাছাড় জেলার শিলচর শহরে। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই দেখ আসছি সাপ্রদসাম্প্র বাতাবরণের কি কুটিল পরিকল্পনার বলি হতো সাধারণ মানুষ।৫৭সাল থেকে কাছাড়ের বৎসরের দুটো স্বাভাবিক ছুটি ছাড়া আরও দুটি ছূটি আমরা পেতাম তাহলে হলো বন্যা আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য।কারন মুসলীম গ্ৰাম বা বসতির সংলগ্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ইস্কুল ঘরে এসে আশ্রয় নিতেন দাঙ্গার বলি হয়ে।আর ব্ন্যার সময় যখন ঘর,জমি বন্যায় আক্রান্ত হতো। সেই সময় কমিউনিষ্টদের বিদগ্ধ নেতা অচিন্ত্য ভট্টাচার্য, তারাপদ ভট্টাচার্জররা কমিউনিষ্ট আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন।আর কংগ্ৰেসের কাছাড়ের নের্তৃত্বে ছিলেন,মৈনুলখ চৌধুরী,সতিন্দ্র মোহন দেবরা। তখন থেকেই একটা মিথ চালু ছিলো সৈদুল্লার কাউন্সিল সরকারের সময়ে কাছাড়ের সম্পুর্ণ প্রশাসনিক ব্যবস্থা মুসলিমি করন করে রাতভর শিলচর শহরে ঘুমন্ত নাগরিকদের আক্রমনের এক কষা হয়েছিল আর সেই সময় তরুণ সতিন্দ্র মোহন একটি জীপ গাড়ি নিয়ে তাতে মাইক লাগিয়ে সমস্ত শহর বাসিকে জাগীয়ে হিন্দুদের রক্ষা করছিলেক। সেই যুগে কাছাড়ের অবিবাংশীত হিন্দু সম্প্রদায়ের তিনি ছিলেন আইকন। তার পরেও ভাত্রীঘাতি ১৯৬১ সনের হাইলাকান্দির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।সেই দিন বি,জে,পি ছিলোনা। কংগ্রেস‌ই ছিলো একছত্র শাষনের ক্ষমতায়?কমিনিষ্টরা ছিলেন!তার পরও সেই সংস্কৃতির লালন পালন কারা করেছিলো?

    উত্তরমুছুন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.