Header Ads

১৯৪৭ সালের গণভোটের মতো এন আর সির ফলে বাঙালিদের ভাগ্য বিপৰ্যয় শুরু হল

পরিকল্পিতভাবে এন আর সি থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ

অমল গুপ্ত, গুয়াহাটিঃ 
অসমের বহু প্ৰত্যাশিত জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর (এন আর সি) তালিকা থেকে ৪০ লক্ষ ৭ হাজার ৭০৭ জন মানুষের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই কিন্তু বিদেশী নন, কিন্তু দেশের ‘সেকেণ্ড কমাণ্ডার ইন চিফ' অমিত শাহ সংসদে এক বিবৃতি দিয়ে বলেই ফেললেন, ‘‘৪০ লক্ষ মানুষ ভারতীয় নাগরিক নয়, ‘ঘুষপটিয়া' অৰ্থাৎ অবৈধ নাগরিক।'' অপর দিকে কেন্দ্ৰীয় স্বরাষ্ট্ৰমন্ত্ৰী রাজনাথ সিং সংসদে আশ্বাস দিয়ে বললেন, প্ৰকৃত ভারতীয়দের নাম বাদ পড়বে না, দাবি আপত্তির মাধ্যমে নাম নথিভূক্তি করতে পারবে। সুপ্ৰীমকোৰ্ট, এন আর সি কৰ্তৃপক্ষ এবং অসমের মুখ্যমন্ত্ৰী সৰ্বানন্দ সনোয়ালও সেই প্ৰতিশ্ৰুতিই দিয়েছেন। দাবি আপত্তির সময়সীমা ধাৰ্য করা হয়েছে ৭ আগষ্ট থেকে ২৮ সেপ্তেম্বর পৰ্যন্ত। মাত্ৰ ৫২ দিনে ৪০লক্ষ দাবি আপত্তি নিস্পত্তি করা কি সম্ভব? প্ৰায় ৩ বছর ধরে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে লক্ষ লক্ষ নথিপত্ৰ পরীক্ষা করে ২ কোটি ৮৯ লক্ষ মানুষের নাম তালিকায় অন্তভূক্ত করল। সেই তালিকায় হাজার হাজার ভুল ভ্ৰান্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কয়েক লক্ষ বৈধ নাগরিকের নাম বাদ পড়েছে। এক জনের লিগাসি ডাটা অন্যেরা ব্যবহার করেছে বলে বহু অভিযোগ পাওয়া গেছে। কয়েক লক্ষ ভূমিপুত্ৰ খিলঞ্জীয়া মানুষের নামও বাদ পড়েছে। মাত্ৰ ৬-৭ হাজার টাকার বেতনে চুক্তি ভিত্তিক অস্থায়ী কৰ্মচারীদের সঙ্গে সরকারী কৰ্মচারীরাও এই কাজ করেছেন। তাদের দায়বদ্ধতা নিয়ে কেউ প্ৰশ্ন তোলে নি। সুপ্ৰীমকোৰ্টের মডেলিটি, রেজিষ্টার জেনারেল অফ ইণ্ডিয়ার (আর জি আই) গাইডলাইন অনুযায়ী অত্যন্ত স্পৰ্শকাতর জাতীয় স্বাৰ্থ থাকা দেশের প্ৰথম জাতীয় নাগরিকপঞ্জী প্ৰস্তুত করার ক্ষেত্ৰে প্ৰথম দিকে যে ভাবে সতৰ্কতা অবলম্বন করা হয়েছিল শেষের দিকে সব বাঁধন হালকা হয়ে পড়ে। গ্ৰাম অসমের তৃণমূল পৰ্যায়ের মডেলিটি, গাইডলাইন কাজে আসে নি। রাতারাতি নিয়ম নীতি না মেনে বহু এন আর সি কৰ্মীকে রদ বদল করা হয়। কেন করা হয়েছিল তার কোনও সদুত্তর নেই। বিভিন্ন সূত্ৰের নিৰ্দিষ্ট খবর আছে এন আর সির কাজে কোনও তৃতীয় পক্ষ হস্তক্ষেপ করেছিল। এন আর সির কৰ্তৃপক্ষের সীল মোহর ছাড়াই সাদা কাগজে ‘ডি' ভোটার লিখে হাজার হাজার বৈধ নাগরিককে সন্দেহজনক তালিকায় ছূঁড়ে ফেলা হয়। গুয়াহাটি মহানগর এবং রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু প্ৰতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বের নাম এন আর সি তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বরাক উপত্যকায় কবিন্দ্ৰ পুরকায়স্থ এবং ব্ৰহ্মপুত্ৰ উপত্যকায় প্ৰয়াত মহিতোষ রায় এবং তার ভাই প্ৰাণোতোষ রায় অসমে জনসংঘ এবং আর এস এস-র জন্মদাতা। সেই প্ৰাণোতোষ রায় এবং তার পুত্ৰ কন্যার নাম তালিকায় নেই। রাজ্যে বাঙালিদের সুরক্ষার স্বাৰ্থে গঠিত নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখর দে তার নামও বাদ পড়েছে। গুয়াহাটি বার কাউন্সিলের পাঁচ বারের সভাপতি সোমেশ রঞ্জন ভট্টাচাৰ্যের নাম আছে, কিন্তু তার পত্নীর নাম নেই। গুয়াহাটি হাইকোৰ্টের আইনজীবি সহদেব দাসের পত্নীর নামও নেই। ধুবড়ি জেলা আদালতের বার কাউন্সিলের প্ৰাক্তন সদস্য মহুয়া দাসের নাম নেই। বরাকের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্ৰোতভাবে জড়িত তথা গুয়াহাটির বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনিন্দ্ৰ রায়ের নাম নেই ও তার কন্যাদের নামও বাদ পড়েছে। বিটিএডি এলাকার পানেরি, টংলা, বকো, কলাইগাঁও, খারুপেটিয়া, বাক্সা, চিরাং প্ৰভৃতি এলাকায় নিম্ন বৰ্গের বাঙালি হিন্দুদের হাজার হাজার নাম বাদ পড়েছে। ওদালগুড়ির খরং, গোলমা প্ৰভৃতি অঞ্চলে বসবাসকারী নেপালী জনগোষ্ঠীর মানুষের নাম একচেটিয়া ভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। ব্যাখ্যা দেওয়া হবে ভুল হয়ে গেছে। ফেন্সি বাজারের ১৯৫১ সালেরর আগে আসা পুরনো বহু ব্যবসায়ীর নাম বাদ পড়েছে। ষ্টেডিয়ামের কাছে অবস্থিত দক্ষিণ ভারতের এবং বিহারের কয়েক শ মানুষ, জিএমডি-এর অধীনে দীৰ্ঘ বছর কাজ করছেন তাদের নামও একচেটিয়া ভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৯৩৭ সালে গুয়াহাটি পৌরসভার পৌরপতি হিসাবে সাদুল্লা সাহেব দক্ষিণ ভারত থেকে কাজের মানুষগুলিকে এনেছিলেন। হোজাইয়ের এস ও এস ভিলেজের সব আবাসিকদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব কাঁপানো নেলী হত্যাকাণ্ডে অনাথ হওয়া ছেলে মেয়েগুলোকে হোজাইয়ের এস ও এস ভিলেজে রাখা হয়েছিল। নেলীর স্মৃতি মুঁছে ফেলার জন্য হয়তো এস ও এস ভিলেজের কয়েক শ অনাথের নাম বাদ দেওয়া হলো। রাজ্যে প্ৰাক্তন মুখ্যমন্ত্ৰী আনোয়ারা তাইমূরের নামই নেই। প্ৰাক্তন মুখ্যমন্ত্ৰীর নাম যিনি বাদ দিলেন সেই এন আর সি সেবা কেন্দ্ৰের কৰ্মীর যোগ্যতা নিয়ে প্ৰশ্ন উঠে। মরিগাঁও জেলার ডেপুটি কমিশনার হেমেন দাস  অন্য অভিযোগও করেছেন, বিদেশী শনাক্তকরণ ট্ৰাইব্যুনালে বিদেশী ঘোষিত প্ৰায় ২০০জনের নাম এন আর সি তালিকায় অন্তভূক্ত হয়েছে। বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেব অভিযোগ করেছেন, প্ৰকৃত খিলঞ্জীয়ার নাম বাদ পড়েছে এবং বাংলাদেশী মুসলিমদের নাম অন্তৰ্ভূক্ত হয়েছে। তার অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্ৰী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অসমের বাঙালি হিন্দুদের স্বাৰ্থে কথা বলছেন না, তার লক্ষ্য বাংলাদেশী মুসলিম, তাদেরকে সংরক্ষণ দিয়ে ভোট রাজনীতি করতে চাইছেন। অসম বাঙালি যুব-ছাত্ৰ ফেডারেশনের উপদেষ্টা চিত্ত পাল অভিযোগ করেছেন যে ২০০৫ সালে সুপ্ৰিম কোর্ট আই এম(ডিটি) বাতিল করার পর রাজ্যের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বিশেষ করে ভাষিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর রক্ষা কবস হিসেবে ইমিগ্র্যাণ্ট এক্সপালশন ফ্রম আসাম, ১৯৫০ লাগু হয়েছিল। সে আইনটিকে বাতিল করার জন্য ষড়যন্ত্ৰ শুরু হয়েছে। কিন্তু শাসক দলের মন্ত্ৰী-বিধায়করা বিস্ময়করভাবে চুপ আছেন। বিভিন্ন সূত্ৰ থেকে আর এক অভিযোগ পাওয়া গেছে যে রাজ্যের বিদ্যুৎ পরিস্থিত অত্যন্ত খারাপ। গ্ৰাম অসমের প্ৰত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ থাকেনা বল্লেই চলে। এন আর সি সেবাকেন্দ্রগুলিতে ডাটা এণ্ট্ৰির কম্পিউটারগুলো সব বিকল। বাইরে থেকে হাজার হাজার নথি সেই কম্পিউটারগুলিতে পরে আপলোড করা হয়েছে। অসম-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জিলাগুলিতে এন আর সি থেকে বাদ পরা লোকের সংখ্যা অনেক কম। ১৩৪ কিলোমিটার অসম-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ধুবরীর জনসংখ্যা প্ৰায় ১৯ লক্ষ। সেখানে বাদ পড়েছে প্ৰায় ৮.৪ শতাংশ, করিমগঞ্জ জেলায় বাদ পড়েছে ৮.৪৬ শতাংশ। সব থেকে বেশি বাদ পড়েছে দরং জেলায় ৩১.০৩ শতাংশ। তার পরেই নগাঁও জেলায়। সেখানে ৩০.৪২ শতাংশ।

গত এপ্ৰিল মাস পৰ্যন্ত এন আর সির সমন্বয়ক প্ৰতীক হাজেলা সুপ্ৰীম কোৰ্টের নিৰ্দেশ মেনেই যথারীতি কাজ করছিলেন, তার পর পঞ্চায়েত নথি, রেশন কাৰ্ড, জন্ম প্ৰমাণপত্ৰ, শরনাৰ্থী সাৰ্টিফিকেট প্ৰভৃতি প্ৰামাণ্য নথিকেও অগ্ৰাহ্য করতে শুরু করা হল, খুঁশি মতো তালিকা থেকে নাম কাটা শুরু হয় বলে সচেতন মহল ভূরিভূরি অভিযোগ করেছে। বিশেষ করে পঞ্চায়েত নথি বাতিল করায় বিবাহিত মহিলা এবং তাদের সন্তাদের নাম বেশি বাদ পড়েছে। একজন সাধারণ মানুষ দুদিনের পুরণো নথি খুঁজে পান না, এন আর সি কৰ্তৃপক্ষ ১৯৭১ সালের আগে ৪০-৫০ বছর পুরণো নথি খুঁজে আনার নিৰ্দেশ দিেচ্ছন। সরকার ১৯৫১ এমনকি ১৯৬৬ সালের ভোটার তালিকা সংরক্ষণ করতে পারে নি, তারাই এখন ৪০-৫০ বছর আগের নথি দাখিলের দাবি করছে। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তি যুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ বাঙালি হিন্দু পূৰ্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে বিশেষ করে বাঙালি প্ৰধান ত্ৰিপুরা, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অসমে আশ্ৰয় নিয়েছিল। সব সম্পত্তি খুইয়ে ছিন্নমূল অবস্থায় প্ৰাণের তাগিদে ভারতে আশ্ৰয় নিয়েছিল। তারা কোনও দিন ভাবেনি হিন্দুস্থানে এলেও হিন্দু ধৰ্মাবলম্বী মানুষদেরও নাগরিকত্বের প্ৰমাণ পত্ৰ দাখিল করতে হবে। ১৯৩৭ সালে কংগ্ৰেসের সভাপতি থাকা কালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্ৰ বসু অসমে এসে সাদুল্লা সরকারের পতন ঘটিয়ে গোপীনাথ বরদলৈকে মুখ্যমন্ত্ৰীর আসনে বসিয়ে পূৰ্ব পাকিস্তানের হাত থেকে আসামকে রক্ষা করে ছিলেন। অপর দিকে শ্যামা প্ৰসাদ মুখোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গেকে পূৰ্ব পাকিস্তানের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন। ইতিহাস সে কথায় বলছে। ১৯৪৭ সালের ২৩ জুলাই বৃহত্তর সিলেট ভাগ হল– মুখ্যমন্ত্ৰী (প্ৰিমিয়ার) গোপীনাথ বরদলৈ বললেন, ‘‘সিলেট গেল কিন্তু সিলেটিরা গেল না''। গণভোটের মাধ্যমে ১৯৪৭-সালের ৩ জুলাই বাঙালিদের দুটুকরো করা হল এবং ২০১৮-র ৩০-শে জুলাই আবার 'গণভোট' এন আর সির তালিকা থেকে বাঙালিদের বাদ দেওয়া হল। রাজ্যের ২৫টি নিৰ্বাচন কেন্দ্ৰে বাঙালি হিন্দু ভোটাররা নিৰ্ণায়ক শক্তি, তা দুৰ্বল করে দেওয়া হল, কারণ বাঙালি হিন্দুরা নিজেদের স্বাভিমান বিসৰ্জন দেন না, অসমীয়া ভাষা সংস্কৃতি গ্ৰহণ করে নি, তারা জোটবদ্ধ  হলেই আর একটি ত্ৰিপুরা বানাবে। তা কখনও বরদাস্ত করা হবে না। তাই পরিকল্পিত ভাবে এন আর সিতে এমন ভাবে তাদের নাম কাটা হয়েছে বলে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এন আর সির তালিকা প্ৰকাশের পর ৪০ লক্ষ মানুেষর নাম বাদ পড়ল, লক্ষ লক্ষ প্ৰকৃত ভারতীয় বৈধ নাগরিকের নাম বাদ পড়েছে। রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলি এবং কিছু বুদ্ধিজীবি, প্ৰাক্তন রাজ্যপাল এস কে সিনহার প্ৰতিবেদন এবং ২৫ বছর আগে বিধানসভায় প্ৰাক্তন মুখ্যমন্ত্ৰী হিতেশ্বর শইকিয়ার প্ৰতিবেদন উল্লেখ করে অভিযোগ করেই গেছে রাজ্যে ৬০-৭০ লক্ষ বাংলাদেশী আছে। তদানীন্তন রাষ্ট্ৰপতিকে দেওয়া এস কে সিনহার গোপন প্ৰতিবেদনে বলা হয়েছিল অসম বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে প্ৰতিদিন ৬ হাজার করে বাংলাদেশী অসমে প্ৰবেশ করছে, ত্ৰিপুরা-অসমকে নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সামিল করে বহত্তর বাংলাদেশ গঠনের ষড়যন্ত্ৰ করছে। হিতেশ্বর শইকিয়া বলেছিলেন, অসমে ৩০ লক্ষাধিক বাংলাদেশী আছে। এই বিস্ফোরক মন্তব্য করার এক দিন বাদেই তদানীন্তন আমসু সভাপতি আব্দুল আজিজ হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, ৫ মিনিটের মধ্যেই কংগ্ৰেস সরকারকে ভেঙ্গে দেওয়া হবে। তাতে হয়তো সম্ভবত হিতেশ্বর শইকিয়া ভয় পেয়ে ঘোষণা করলেন, রাজ্যে একজনও বাংলাদেশী নেই। প্ৰকৃতাৰ্থে অসমে বাংলাদেশী ইসু্য নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলিঘৃণ্য রাজনীতি করেই যাচ্ছে। হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে এন আর সিতে কত লক্ষ বাংলাদেশী শনাক্ত হবে?? 

২টি মন্তব্য:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.